চাচা আকরাম খান সাবেক অধিনায়ক, বড় ভাই নাফিস ইকবালও খেলেছেন বাংলাদেশের হয়ে, বাবার ইকবাল খান ছিলেন ফুটবলার। তবে মাঝে মাঝে ক্রিকেটও খেলতেন তিনি। ক্রীড়া পরিবারে জন্ম, ভাই ও চাচার মতো ক্রিকেটারের আবহে বড় হওয়া তামিম ইকবাল ক্রিকেটার হবেন সেটা যেন অনুমেয়ই ছিল। ছোটবেলা থেকেই বার সংস্পর্শে বড় হয়েছেন তামিম। তিন ভাই-বোনের মাঝে তামিম ছিলেন দ্বিতীয়। নাফিস ও ছোট বোনের তুলনায় বাবার সঙ্গে তামিমের সখ্যতা ছিল অনেকটা বেশি। বিকেলে হাঁটতে যাওয়া, খাওয়া-দাওয়া কিংবা পেট্রোল পাম্পে যাওয়ার সময়ও বাঁহাতি এই ওপেনারকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন তার বাবা ইকবাল খান। তামিমের বয়স তখন ৮-৯ বছর, সেসময় চিকিৎসার জন্য ভারতে গিয়েছিলেন তিনি। ভারতে যাওয়ার সময় তাকে সঙ্গে করে নিয়েছিলেন তামিমের বাবা।
শুধু তাই নয় কদিনের জন্য ভারতের একটি একাডেমিতেও ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। তবে বাংলাদেশের সদ্য সাবেক অধিনায়কের ক্রিকেটের হাতেখড়িটা হয়েছে তপন নামের একজনের হাত ধরে। যদিও ক্রিকেট বলে তামিমের খেলাটা শুরু তার চাচা আকবর খানের মাধ্যমে, চট্টগ্রামে বিজয় দিবস টুর্নামেন্ট দিয়ে। সালটা ২০০০, বয়স যখন ১১ তখন বাবাকে হারান তামিম। জীবনের সবটা সুখ যেন হারিয়ে বসেন অভিজ্ঞ এই ক্রিকেটার। এরপর বাবার জন্যই ক্রিকেটে মনোযোগ বাড়ে তার। ২০০৭ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের পোর্ট অব স্পেনে জহির খানকে ডাউন দ্য উইকেটে এসে ১৭ বছর বয়সি তরুণ তামিমের শুরু। যা এখনও বাংলাদেশের ক্রিকেটের নতুন যুগের শুরুর প্রতিচ্ছবি। মাঝে লর্ডসের সেঞ্চুরি, ব্যান্ডেজ হাতে দুঃসাহসিকতা দেখিয়ে ব্যাটিংয়ে নামা কিংবা অসংখ্য ম্যাচজয়ী ইনিংস বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ।
১৬ বছরের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে বাংলাদেশের হয়ে ৭০ টেস্ট, ২৪১ ওয়ানডে এবং ৭৮ টি-টোয়েন্টি খেলেছেন তামিম। যেখানে সবমিলিয়ে ২৫ সেঞ্চুরি করেছেন বাঁহাতি এই ওপেনার। বাংলাদেশের একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে তিন সংস্করণে সেঞ্চুরির রেকর্ডও তার।
বেশ কিছুদিন ধরে সময়টা একেবারেই ভালো যাচ্ছিল না তামিম ইকবালের। ফিটনেসের সঙ্গে বাজে পারফরম্যান্স সবশেষ দুবছরে প্রায়শই তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ শুরুর আগেও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে তামিমের ফিটনেস। শতভাগ ফিট না হয়ে ম্যাচ খেলার সিদ্ধান্ত নেয়ায় নাজমুল হাসান পাপনকে কথা শুনিয়েছেন চান্দিকা হাথুরুসিংহে। তবুও একাদশে ছিলেন বাংলাদেশের ওয়ানডে অধিনায়ক।
প্রত্যাশিত পারফরম্যান্স করতে পারেননি এবারও, ম্যাচ হারে বাংলাদেশ। হারের পর কোন অনুশীলন সেশন রাখা হয়নি বাংলাদেশের, তাই তো সাংবাদিকদের কাজও খানিকটা কমে গিয়েছিল। তবে হঠাৎই রাতে তামিম নিজে থেকে জানান ব্যক্তিগতভাবে সংবাদ সম্মেলন করবেন, সময়টা বেলা ১২ টা। যদিও শেষ বেলায় জানানো হয় ১২ নয়, ১ টা ৩০ মিনিটে হবে প্রেস কনফারেন্স।
সময় হওয়ার বেশ কয়েক মিনিট আগেই চট্টগ্রামের এক হোটেলে এসে হাজির তামিম। চোখে মুখে হতাশার ছাপ একেবারে স্পষ্ট। খানিকটা বিমর্ষ দেখাচ্ছিলো বাঁহাতি এই ওপেনারকে। সংবাদকর্মীদের আনাগোনার মাঝে কেবল ক্যামেরার শাটারের শব্দ। ধারণা করা হচ্ছিলো বিশ্বকাপের আগে নেতৃত্ব ছাড়তে যাচ্ছেন তামিম। তবে গুঞ্জনে ডালপালা মেললে জানা যায় নেতৃত্ব নয় একেবারে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটই ছাড়ছেন ওয়ানডে অধিনায়ক।
শেষ পর্যন্ত সেই গুঞ্জনই সত্যিই হলো। জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে রুমে বসে হঠাৎই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বলে দিলেন বাংলাদেশের ইতিহাসের সর্বকালের সেরা ওপেনার। বিদায়ের কথা বলতে গিয়ে কান্না করে বসলেন তিনি। এত এত ক্যামেরার লেন্সের সামনে বসে কত-শত প্রেস কনফারেন্স সামলেছেন সেটার হিসেবে নেই। অথচ সেই তামিম যেন আজ নিজের আবেগ-অনুভূতিকে কয়েক মিনিটের জন্য আটকে রাখতে পারলেন না।
ক্যামেরার লেন্স যখন তাকে ফ্রেমবন্দি করতে ব্যস্ত তখন মাথা নিচু করে কান্না ব্যস্ত তামিম। আবেগপ্রবণ হয়ে পড়া বাঁহাতি এই ওপেনার যেন কিছু বলতেই পারছিলেন না। তবুও খানিকটা সময় নিয়ে অশ্রুসিক্ত চোখে তামিম বললেন, ‘আফগানিস্তানের বিপক্ষে গতকালের ম্যাচটিই আমার ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ। এই মুহূর্ত থেকে আমি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানাচ্ছি। সিদ্ধান্তটি হুট করে নেওয়া নয়। অনেক দিন ধরেই আমি এটা নিয়ে ভাবছি। পরিবারের সঙ্গে কথাও বলেছি এটা নিয়ে।’
কান্নাভেজা চোখে তামিম বলেন, ‘আমি সব সময়ই একটা বলেছি, আমি ক্রিকেট খেলি আমার বাবার স্বপ্ন পূরণ করার জন্য। আমি জানি না তাকে কতটা গর্বিত করতে পেরেছি এই ১৬ বছরে। আমি আরও কয়েকজনকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। আমার সবচেয়ে ছোট চাচা, যিনি ইন্তেকাল করেছেন, তাঁর নাম আকবর খান, যাঁর হাত ধরেই আমি প্রথম ক্রিকেট বলে টুর্নামেন্ট খেলেছি। চট্টগ্রামের এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে তপন দা নামের একজন কোচ আছেন, তাঁর কাছে আমি ঋণী।’