সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২৪

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যগ করে ভারতে আশ্রয় নেন শেখ হাসিনা। তারপর থেকে সেখানেই অবস্থান করছেন তিনি। তবে তার দেশত্যাগের আগে বৈষমবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত হন শত শত মানুষ। সাধারণ মানুষ হত্যার ঘটনায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত শতাধিক মামলা হয়েছে। যারমধ্যে রয়েছে হত্যা, নির্যাতন, গুম, অপহরণ, মানবতা বিরোধী এবং গণহত্যার মতো গুরুতর অপরাধ।

এসব অপরাধের বিচার করতে এখন শেখ হাসিনাকে ফেরত আনার দাবি উঠেছে। হাসিনাকে ফেরত আনা যাবে? ভারত কী তাকে ফেরত দেবে? এমন অবস্থায় শেখ হাসিনাকে বিচারের মুখোমুখি করতে বাংলাদেশে প্রত্যর্পণের জন্য ভারতের ওপর চাপ বাড়ছে। এতে করে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নেমে যাচ্ছে তলানিতে।

আজ শুক্রবার (৬ সেপ্টেম্বর) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে হংকং-ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট।

সংবাদমাধ্যমটি বলছে, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার ব্যাপক আন্দোলনের মুখে ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটিয়ে শেখ হাসিনা হেলিকপ্টারে করে ভারতে আশ্রয় নেন। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য নির্বাচনী কারচুপি এবং বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং জোরপূর্বক গুমের মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপক অভিযোগের দ্বারা তার দেড় দশকের এই শাসনামলকে চিহ্নিত করা হয়।

বৃহস্পতিবার ভারতীয় সংবাদসংস্থা প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়াকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস বলেছেন, তাকে (হাসিনাকে) ফিরিয়ে আনতে হবে, তা না হলে বাংলাদেশের মানুষ শান্তিতে থাকবে না। তিনি যে ধরনের নৃশংসতা করেছেন, তাকে এখানে সবার সামনে বিচার করতে হবে। ড. ইউনূস বলেন, শেখ হাসিনা ভারতে অবস্থান করায় কেউই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। কারণ বিচার করার জন্য আমরা তাকে ফেরত আনতে চাই। তিনি ভারতে রয়েছেন এবং সেখান থেকেই মাঝে মাঝে কথা বলছেন। এটা সমস্যা তৈরি করছে। যদি তিনি চুপ থাকতেন, তাহলে আমরা ভুলে যেতাম। মানুষও এটা ভুলে যেত, যদি তিনি নিজের জগতেই থাকতেন। কিন্তু তিনি ভারতে বসে কথা বলছেন এবং দিক-নির্দেশনা দিচ্ছেন, কেউই এটা পছন্দ করছে না।

এই মন্তব্যের মাধ্যমে ড. ইউনূস স্পষ্টতই গত ১৩ আগস্ট শেখ হাসিনার বক্তব্যের কথাই উল্লেখ করেছেন। ওই সময় শেখ হাসিনা ‘ন্যায়বিচার’ দাবি করেছিলেন এবং বলেছিলেন, সাম্প্রতিক ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড’, হত্যা ও ভাঙচুরের সাথে জড়িতদের অবশ্যই তদন্ত, চিহ্নিত এবং শাস্তি দিতে হবে। ড. ইউনূস পিটিআইকে বলেন, এটা আমাদের বা ভারতের জন্য ভালো নয়। এটি নিয়ে অস্বস্তি রয়েছে। শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশিদের বিচলিত করে এমন রাজনৈতিক বক্তব্য না দিতেও আহ্বান জানান ড. ইউনূস। তিনি বলেন, হাসিনা চুপ থাকলে আমরা ভুলে যেতাম… কিন্তু ভারতে বসে তিনি কথা বলছেন এবং দিত-নির্দেশনা দিচ্ছেন। কেউ এটা পছন্দ করে না।’

বিশ্লেষকরা বলছেন, অধ্যাপক ড. ইউনূসের বিবৃতিটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপরই আলোকপাত করছে। কিন্তু তার দাবিতে রাজি হয়ে শেখ হাসিনাকে নয়াদিল্লি বাংলাদেশের হাতে তুলে দেবে এমন সম্ভাবনা কম।

হরিয়ানার জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত বলেন, ভারত হাসিনাকে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করবে এমন সম্ভাবনা খুবই কম। যা হয়েছে তা হলো– এখন বাংলাদেশের প্রতিটি কর্মকর্তা এবং স্টেকহোল্ডার শেখ হাসিনাবিরোধী এবং ভারতবিরোধী অবস্থান নিতে চায়। তার দাবি, ভারতে হাসিনার উপস্থিতি নিয়ে উত্তেজনা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতারা ভারতের সঙ্গে সম্ভবত দৃঢ় দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করবেন। কারণ উভয় দেশই অন্যথায় তাদের সম্পর্ক হারিয়ে ফেলতে পারে। তিনি আরো দাবি করেন, ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক ছিল এবং আমরা এই সম্পর্ক ধরে রাখতে চাই কারণ এটি উভয় দেশের জন্য সুবিধাজনক।

গত শুক্রবার বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হলে তেমন ক্ষেত্রে প্রত্যর্পণের সম্ভাবনা সম্পর্কে দিল্লিকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। তবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেন, হাসিনাকে প্রত্যর্পণের বিষয়টি এখনো ‘অনুমান-নির্ভর প্রশ্ন’। তিনি আরো বলেন, আমরা আগেই বলেছি, বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নিরাপত্তার কারণে খুব অল্প সময়ের নোটিশে ভারতে এসেছিলেন। এই বিষয়ে আমাদের আর কিছু বলার নেই।

গত মাসে সংসদীয় অধিবেশন চলাকালীন ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো দ্ব্যর্থহীনভাবে হাসিনার নিরাপত্তার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল এবং ভারতে তার আশ্রয় দেয়ার সিদ্ধান্তকেও সমর্থন করেছিল। তবে শেখ হাসিনার বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে ড. ইউনূসের সর্বশেষ মন্তব্যের জবাব এখনো দেয়নি দিল্লি।

অতীতে বাংলাদেশি বিভিন্ন ইস্যুতে লেখালেখি করা লন্ডন ভিত্তিক লেখক প্রিয়জিৎ দেবসরকার বলছেন, প্রতিবেশী দেশগুলোর নেতাদের জন্য ধারাবাহিকভাবে নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে ভারত। তিনি উল্লেখ করেন, শেখ হাসিনা তার নিরাপত্তা ও পরিবারের মঙ্গলের জন্য এর আগেও ভারতে থেকেছেন। ভারতীয় আমলাতন্ত্র স্বল্প এবং মাঝারি মেয়াদে হাসিনার প্রতি তাদের এই আতিথেয়তার বিপরীত কিছু করবে, তেমন সম্ভাবনা খুব কম।

শেখ হাসিনার শাসনামলে অবশ্য ভারতের সঙ্গে দৃঢ় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছিল বাংলাদেশ, বিশেষ করে বাণিজ্যখাতে। ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে উভয় দেশের দ্বিমুখী বাণিজ্যের আকার বেড়ে ১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হয়েছে। ভারতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি ছিল তৈরি পোশাক। এই সময়ের মধ্যে ভারতে মোট ৩৯১ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ।

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে হিন্দু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিয়ে দিল্লির উদ্বেগের কারণেও বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল। ড. ইউনূস বলেছেন, সংখ্যালঘুদের অবস্থাকে এত বড় আকারে চিত্রিত করার চেষ্টা করার বিষয়টি আসলে অজুহাত মাত্র। বিশ্লেষকরা বলছেন, দিল্লির অপ্রমাণিত এসব অভিযোগ ভারতের অভ্যন্তরে ইসলামোফোবিয়াকে উসকে দিতে পারে। এছাড়া গত মাসে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে ভয়াবহ বন্যার কারণেও বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কে টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে। উত্তর-পূর্ব ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের দুম্বার বাঁধ থেকে পানি ছাড়ার কারণে এই বন্যা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে বাংলাদেশ।

শেয়ার দিয়ে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *