বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের আয়ের চেয়ে ব্যয় অনেক বেশি। ফলে লোকসানে আছে স্যাটেলাইটটির পরিচালনাকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিএল)। যদিও ‘কৌশলে’ তারা নিজেদের লাভজনক দেখাচ্ছে। এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে প্রথম আলো। বিএসসিএলের সর্বশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদন (২০২১-২২) অনুযায়ী, কোম্পানিটির মুনাফা ৮৫ কোটি টাকা। যদিও মুনাফার এই হিসাব করার ক্ষেত্রে স্যাটেলাইটের অবচয় বা ডেপ্রিসিয়েশন ধরা হয়নি। অবচয় ধরা হলে মুনাফার বদলে লোকসান দাঁড়াবে প্রায় ৬৬ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরেও প্রায় সমপরিমাণ লোকসান ছিল।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মেয়াদ ১৫ বছর। এর সম্পদমূল্য দেখানো হয়েছে ২ হাজার ৭৮৪ কোটি টাকা। ফলে বছরে অবচয় (স্ট্রেইট লাইন মেথড) দাঁড়ায় প্রায় ১৮৬ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) প্রকল্পের মাধ্যমে ২০১৮ সালে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল। ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি এর মালিকানা হস্তান্তর করা হয় নতুন কোম্পানি বিএসসিএলের কাছে। এই কোম্পানি গঠন করা হয় স্যাটেলাইটটির পরিচালনার জন্য। তাদের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে (২০২১-২২) স্যাটেলাইটের সম্পদের বিপরীতে অবচয় দেখানো হয়নি। স্যাটেলাইট থেকে আয় দেখানো হয়েছে। ফলে কোম্পানিটির মুনাফা দাঁড়িয়েছে ৮৫ কোটি টাকা। যদিও ১৮৬ কোটি টাকা অবচয় বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, বিএসসিএল ওই অর্থবছরে লোকসান করেছে ৬৬ কোটি টাকা।
বিএসসিএলের নিরীক্ষা করেছে এস এফ আহমেদ অ্যান্ড কোম্পানি। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্যাটেলাইট বাবদ সম্পদের পূর্ণাঙ্গ তথ্য বিএসসিএল তাদের সম্পদ বিবরণীতে উল্লেখ করেনি। বিএসসিএলের যুক্তি, বিটিআরসি তাদের সম্পদ বিবরণী থেকে স্যাটেলাইটের সম্পদমূল্য হস্তান্তর করেনি। নিরীক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান আরও বলেছে, স্যাটেলাইটের সম্পদমূল্য না দেখানোয় বিএসসিএলের সম্পদ বিবরণী ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে পারে।
যদিও একই অর্থবছরে বিটিআরসির নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট বাবদ কোনো সম্পদ দেখানো হয়নি। আগের অর্থবছরগুলোতে দেখানো হয়েছিল। ২০২১-২২ অর্থবছরে বিটিআরসি স্যাটেলাইটের সম্পদের বিপরীতে অবচয় ঠিকই দেখিয়েছে।
বিএসসিএলের নিরীক্ষা প্রতিবেদনটি নিয়ে তিনজন সনদধারী হিসাববিদের মতামত নিয়েছে। তিনজনই বলেছেন, অবচয় না দেখানোয় বিএসসিএল লাভজনক কোম্পানি মনে হচ্ছে। অবচয় ধরা হলে প্রতিষ্ঠানটি সংশ্লিষ্ট অর্থবছরে লোকসানি হিসেবে গণ্য হবে।
হিসাববিদদের সংগঠন দ্য ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশের (আইসিএবি) সাবেক সভাপতি হুমায়ুন কবির বলেন, নিরীক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানই তাদের প্রতিবেদনে বিষয়টি নিয়ে ডিসক্লোসার (ঘোষণা) দিয়েছে। যে সম্পদ থেকে কোম্পানির আয় হয়, তার অবচয় না দেখালে প্রকৃত আর্থিক চিত্র উঠে আসে না।
উল্লেখ্য, শুধু ২০২১-২২ অর্থবছর নয়, এখন পর্যন্ত নিরীক্ষার আওতায় আসা কোনো অর্থবছরেই বিএসসিএল লাভ করতে পারেনি। আগামী বছরগুলোতেও পারবে কি না, সে সন্দেহ রয়েছে। কারণ তাদের আয় খরচের তুলনায় অনেক কম।
স্যাটেলাইটের ছয় বছর
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট তৈরি করেছে ফ্রান্সের থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেস নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ২০১৮ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎপেক্ষণ করা হয়। সেদিন কেনেডি স্পেস সেন্টারে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়, সাবেক প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম, জুনাইদ আহ্মেদসহ সরকারের একটি প্রতিনিধিদল উপস্থিত ছিল।
স্যাটেলাইটের সফল উৎক্ষেপণের পরপরই সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানান শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘মহাকাশে আজ উড়ল বাংলাদেশের পতাকা। আজ থেকে আমরাও স্যাটেলাইট ক্লাবের গর্বিত সদস্য হলাম।’
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ৫৭তম দেশ হিসেবে স্যাটেলাইটের ক্লাবে যুক্ত হয় বাংলাদেশের নাম। তখন সরকারের পক্ষ থেকে স্যাটেলাইটটির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয়সহ নানা সুফলের কথা বলা হয়েছিল। অপরদিকে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন কেউ কেউ।
বিএসসিএলের লাভ-লোকসানের হিসাব নিয়ে শুরু থেকেই লুকোচুরি করা হতো। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের আয়-ব্যয়ের হিসাব খোঁজ করা হলে বিএসসিএল ২০২১-২২ অর্থবছরের নিরীক্ষা প্রতিবেদন পাঠিয়ে দেয়। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বলা হয়, সমাপ্ত হওয়া ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরের নিরীক্ষা প্রতিবেদন এখনো তৈরি হয়নি।
বিএসসিএল ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান। এই মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। ৩ সেপ্টেম্বর নাহিদ ইসলামের উপস্থিতিতে এক বৈঠকে নিজেদের কার্যক্রম তুলে ধরে বিএসসিএল। সেখানেও রাজস্ব আয়ের হিসাব তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু লাভ-লোকসানের তথ্য দেওয়া হয়নি।
আয় কত
বিএসসিএলের ২০২১-২২ অর্থবছরের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা যায়, কোম্পানিটির মোট আয় হয়েছে ১৩০ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরে যা ছিল ১২৯ কোটি টাকার মতো। আয়ের প্রায় পুরোটা আসে দেশে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ও বিদেশি কিছু চ্যানেলের কাছে ব্যান্ডউইথড বিক্রি করে।
বিএসসিএলের সম্পদ বিবরণীতে স্থায়ী ও চলতি সম্পদের তালিকায় স্যাটেলাইট নেই। অবচয় দেখানো হয়েছে দুই কোটি টাকার মতো, যা প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য সম্পদের, স্যাটেলাইটের নয়। যদিও একই অর্থবছর বিটিআরসি স্যাটেলাইটের সম্পদমূল্য বাবদ ১৮৬ কোটি টাকা অবচয় দেখিয়েছে। ওই বছর বিটিআরসির রাজস্ব আয় ছিল প্রায় ৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। ফলে স্যাটেলাইট বাবদ ধরা অবচয় বিটিআরসির আয়-ব্যয়ে তেমন প্রভাব ফেলেনি।
সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের অবচয় বিটিআরসি তার হিসাবে দেখাচ্ছে। অন্যদিকে সেই অবচয় না দেখানোর কারণে বিএসসিএল লাভজনক কোম্পানি হিসেবে গণ্য হচ্ছে। যদিও স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করে প্রকল্পের অর্থ ও দৈনন্দিন খরচ মিলিয়ে যে ব্যয় তা উঠছে না।
লোকসান নিয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল বিএসসিএলের সাবেক চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শাহজাহান মাহমুদের কাছে, যিনি ৫ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠানটি থেকে বিদায় নেন। তিনি বলেন, এটা লোকসানের প্রকল্প না। যেভাবে এখন আয় হচ্ছে, তাতে আরেকটি স্যাটেলাইট করার জন্য সরকারের কাছে হাত পাততে হবে না।
যদিও বিএসসিএলের হিসাব বলছে, বছরে তাদের যে আয় হয়, তা অবচয়ের টাকার পরিমাণের চেয়ে কম, অন্যান্য খরচ দূরে থাক। অবচয় না ধরে তারা মুনাফা দেখিয়ে সেই টাকা রিটেইন্ড আর্নিংস বা অবিতরণকৃত আয় হিসেবে দেখায়।
বিএসসিএলের মহাব্যবস্থাপক (বিক্রয় ও বিপণন) শাহ আহমেদুল কবির বলেন, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট বিটিআরসির অধীনে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত অবচয়ের হিসাব বিটিআরসি ধরত। পরের অর্থবছর থেকে এটি স্যাটেলাইট কোম্পানির হিসাবে চলে এসেছে। তিনি দাবি করেন, বিএসসিএল লোকসান করে। তবে পরিমাণ কমে আসছে।
দ্বিতীয় স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের উদ্যোগ
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পতনের আগে আওয়ামী সরকার বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ উৎক্ষেপণের উদ্যোগ নিয়েছিল। গত ২০ জুন সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলক বলেছিলেন, চার বছরের মধ্যে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ উৎক্ষেপণ করা হবে। এর আগে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ উৎক্ষেপণের জন্য রুশ ফেডারেশনের গ্লাভকসমসের সঙ্গে সহযোগিতা স্মারক সই করে বাংলাদেশ।
সার্বিক বিষয়ে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ খলিলুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের নিজস্ব স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু স্যাটেলাইটটি ব্যবহারের জন্য সঠিক ব্যবসায়িক পরিকল্পনা করা হয়নি। স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের পর যে প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও দেশীয় বিশেষজ্ঞ গড়ে ওঠার কথা, সেটা হয়েছে কি না, সে প্রশ্ন সামনে আসা উচিত।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠানকে (স্পারসো) বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের কোনো পর্যায়েই যুক্ত করা হয়নি। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করলে স্যাটেলাইটের সঙ্গে তাদের যুক্ত করা প্রয়োজন ছিল। এখন বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের লোকসান কমিয়ে ব্যবসা বাড়ানোর পরিকল্পনা করতে হবে।