নভেম্বর ১৫, ২০২৪

জওহরলাল নেহরুর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তা আর এন কাও ১৯৮৯ সালের এপ্রিলের শেষদিকে সানডের সংখ্যায় লিখেছেন, ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে আমি নিজে ঢাকায় এসে মুজিবকে এ ষড়যন্ত্রের খবর দিই। কিন্তু মুজিব সেটি উড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘ওরা আমার সন্তান। আমার কোনো ক্ষতি ওরা করবে না।’ শুধু তাই নয়, ১৯৭৫ সালের মার্চে কাও তার একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে ঢাকা পাঠান। শেখ মুজিবুর রহমানকে তিনি জানান, সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া ও গোলন্দাজ অংশের দুটি ইউনিটে তার বিরুদ্ধে হত্যার ষড়যন্ত্র চলছে। এবারও বঙ্গবন্ধু এ সতর্কবার্তায় কান দেননি। কারণ তিনি ভেবেছিলেন, যাদের জন্য তিনি প্রাণ বাজি রেখেছিলেন, যাদের তিনি সন্তান হিসেবে জানেন তারা তাকে কেন হত্যা করবে!

হাজার বছরের পরাধীন জাতিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এনে দিয়েছিলেন স্বাধীনতা। তিনি এ দেশের মানুষের জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন, রক্ত ঝরিয়েছেন। তার বিনিময়ে স্বাধীন দেশে কেউ তার রক্ত ঝরাবে, এটি ছিল তার কাছে সম্পূর্ণ অকল্পনীয় বিষয়। যার কারণে তিনি রাষ্ট্রপতি হয়েও অবাধে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশেছেন, সর্বত্র যাতায়াত করেছেন নির্দ্বিধায়।

১৯৭১ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনীর স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের অধিনায়ক ছিলেন মেজর জেনারেল সুজান সিং উবান। তার লেখা ‘ফ্যান্টম্স্ অব চিটাগং’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, ‘এবারও আমি লক্ষ করলাম, তার বাসায় কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। সব রকমের মানুষ সময়-অসময়ে যখন-তখন এসে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার চাইত। তার সঙ্গে দেখা করতে আসা লোকদের কোনো বাছবিচার নেই। এ কথা তুলতেই তিনি বললেন, ‘আমি জাতির জনক, দিন বা রাতে কোনো সময়েই তো আমি আমার দরজা বন্ধ করে দিতে পারি না।’ বঙ্গবন্ধুর এমন সরল বিশ্বাসকে পুঁজি করে নিয়েছিল পঁচাত্তরের ঘাতকরা। ভারতীয় গোয়েন্দা বিভাগ বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, এ কথা বঙ্গবন্ধুকে জানালেও তিনি গুরুত্ব দেননি।

১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট রাত আটটায় বঙ্গবন্ধু ধানমন্ডির নিজ বাসায় ফিরেছিলেন। তার সহকারী এএফএম মুহিতুল ইসলামের তথ্যমতে, সেদিন বঙ্গবন্ধু পরিবার রাত ১২টার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ে। গভীর রাতে ঘাতকরা ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে হামলা চালায়। তাদের গুলিতে প্রথম শহীদ হন শেখ কামাল। সর্বশেষ ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয় মাত্র দশ বছর বয়সী শেখ রাসেলকে।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মুহূর্তটি বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বর্ণনা দিয়েছিলেন মুহিতুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘শেখ কামালকে হত্যার পর হত্যাকারীরা বেপরোয়া গুলি চালিয়ে বাড়ির ওপরের দিকে যাচ্ছিল। ওপরে উঠেই শুরু হয় নির্বিচার হত্যাকান্ড। চারদিকে তখন শুধু গুলির শব্দ। ওপরে তো তা-বলীলা চলছে। চারদিকে একটা বীভৎস অবস্থা। ঠিক সে মুহূর্তে ওপর থেকে চিৎকার শুরু করল যে পাইছি পাইছি। এর পর বঙ্গবন্ধুর একটা কণ্ঠ শুনলাম। তিনি বললেন, তোরা আমাকে কোথায় নিয়ে যেতে চাস? এর পর ব্রাশফায়ার। বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠ আমরা আর শুনতে পাইনি।’ ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ঘৃণিত অধ্যায় লেখা হলো। সপরিবারে নিহত হলেন জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। সেদিন তারা শুধু জাতির জনককে হত্যা করেনি, একই সঙ্গে হত্যা করতে চেয়েছিল বাঙালির সংস্কৃতি ও বাংলাদেশকে। তারা বাংলাদেশকে এবং বাঙালির কণ্ঠ রোধ করতে চেয়েছিল। তাদের প্রকৃত লক্ষ ছিল বাঙালি জাতি এবং বাংলাদেশকে অভিভাবকহীন করা। বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তান তৈরি করা। তখন বাঙালি বোঝেনি ‘পিতা’ হারানোর বেদনা এত দুঃসহ হবে। পুরো বাঙালি জাতি যেন পিতৃহীন হয়ে গেল।

সেই কালো রাতে শহীদ হয়েছিলেন যারা
১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টের কালরাতে ঘাতকের হাতে নিহত হন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী শেখ ফজিলাতুননেছা, পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, জামালের স্ত্রী রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, এসবি অফিসার সিদ্দিকুর রহমান, কর্ণেল জামিল, সেনা সদস্য সৈয়দ মাহবুবুল হক, প্রায় একই সময়ে ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মণির বাসায় হামলা চালিয়ে শেখ ফজলুল হক মণি, তাঁর অন্ত:সত্তা স্ত্রী আরজু মণি, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াতের বাসায় হামলা করে সেরনিয়াবাত ও তার কন্যা বেবী, পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত বাবু, আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বড় ভাইয়ের ছেলে সজীব সেরনিয়াবাত এবং এক আত্মীয় বেন্টু খান।

 

শেয়ার দিয়ে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন...