ডিসেম্বর ২২, ২০২৪

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বলেছেন, বিনিয়োগকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ও পরিস্থিতির কারণে শেয়ার বাজারে ফ্লোর প্রাইস আরোপ করা হয়েছে। শিগগিরই একটা শক্ত অবস্থান দেখতে পেলেই ফ্লোর প্রাইস উঠিয়ে দেব। অপেক্ষায় আছি কখন এই ফ্লোর প্রাইস তুলে দিতে পারবো।

মঙ্গলবার (১১ জুলাই) ইকনোমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত ‘বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের জন্য অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ: সম্ভাব্য প্রতিকার’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

ইআরএফ’র সভাপতি মোহাম্মদ রাফায়েত উল্লাহ মৃধার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ইআরএফ এর সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম।

অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ডের (সিএমএসএফ) চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমান, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) চেয়ারম্যান ড. হাফিজ মোহাম্মদ হাসান বাবু, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহিম, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের চেয়ারম্যান এসএস পারভেজ তমাল, অ্যাসোসিয়েশন অফ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিজ অ্যান্ড মিউচুয়াল ফান্ডের (এএএমসিএমএফ) চেয়ারম্যান হাসান ইমাম, পিএইচডি। এছাড়া অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইআরএফ সদস্য মোহাম্মদ মোফাজ্জল হোসেন।

বিএসইসি চেয়ারম্যান বলেন, আমাদের কমিশনের বয়স প্রায় তিন বছর ২ মাস। আমরা যেদিন দায়িত্ব নিয়েছিলাম সেদিন বাংলাদেশের সব মানুষ ঘরে থাকতো। সে সময় কোন ইকোনমিক কার্যক্রম ছিলো না। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধ যে হঠাৎ শুরু হবে তাও আমরা বুঝতে পারিনি। এটা আমাদের অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদ। এর ফলে শুরুতেই এটা বোঝা যাচ্ছিলো খাদ্যশস্যেরএকটা ক্রাইসিস শুরু হবে কারণ, মধ্য এশিয়া আর ইউরোপের এই অঞ্চলটা খাদ্যশস্যের ভাণ্ডার। যার ফলে নিম্ম ও মধ্য আয় দেশগুলোর বিপদ শুরু হয়। রাশিয়া জ্বালানি সরবরাহ করে থাকে। তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে চাপ পরলো জ্বালানি খাতের ওপর। যার ফলে এলএনজিসহ সব জ্বালানির দাম বাড়লো। আর এর প্রভাব পরলো শিল্প কারখানাসহ বিভিন্ন সেক্টরের ওপর।

রাষ্ট্রায়ত্ব ২৬ কোম্পানির শেয়ার বাজারে আনা সংক্রান্ত রাইজিংবিডির এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শেয়ার বাজারে ভালো শেয়ার আনার উদ্যোগ হিসেবে অনেক দিন ধরে রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠানগুলো শেয়ার বাজারে আনার প্রচেষ্টা চলছে। এই নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বসা হবে।

শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বলেন, পুঁজিবাজারে এতগুলো চাপ, যেখানে ঠোঁটের নড়াাচড়ার প্রভাবে মার্কেটের সূচক ওঠা-নামা করে। অন্যদিকে আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম রিজার্ভের সঙ্গে সাপ্লাই ভোলাটিলিটি কমতে শুরু করেছে। সঙ্গে ক্যাপিটাল মার্কেটের ইনডেক্সও। আর তাই বিনিয়োগকারীদের নিরাপত্তার স্বার্থে ফ্লোর প্রাইজ আরোপ করা হয়। আমরা তখন নিজেদের অনিচ্ছাতেই ফ্লোর প্রাইস দিয়েছিলাম।

তিনি বলেন, একজন শিক্ষক হিসেবে আমি দেখেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্সে পরে এমন অনেক শিক্ষার্থীরা ব্যাংকে যায় ইন্টার্ন করতে। সবাই চায় ব্যাংকে চাকরি করতে, অথচ আমাদের পুঁজিবাজার কত বিশাল একটা সেক্টর, এখানে মার্চেন্ট ব্যাংক আছে, ব্রোকারেজ হাউজগুলো আছে। এজন্যই মার্কেটে মিসিং কম্পোনেন্ট অনেক বেশি। আমি আসার পর অনেক শিক্ষার্থীকেই ইন্টার্ন করতে এখানে নিয়ে আসি।

বিএসইসি চেয়ারম্যান বলেন, আইএমএফ ওয়ার্ল্ড ব্যংকের টিমের চাপ আছে বিভিন্ন সরকারি বন্ডের মাধ্যমে ব্যাংক এবং বিনিয়োগকারীদের প্রটেকশন দেওয়া। সেন্ট্রাল ব্যাংক এবং সরকারের পদক্ষেপের কারণে আমাদের কারেন্ট অ্যাকাউন্টের ফ্লো আবার স্বাভাবিক হয়েছে। যার ফলে এলসি খোলা নিয়ে যে ঝামেলা ছিলো সেটা এখন নেই। আশা করা যায় দ্রুত রিজার্ভ বাড়তে শুরু করবে। আর ডলারের দাম কমবে। আস্তে আস্তে আবারও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। জিনিসপত্রের দাম কমে আসলে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়বে। লিকিউডিটি ক্রাইসিসেরই সব থেকে নেতিবাচক চাপ পরেছিল আমাদের ক্যাপিটাল মার্কেটে।

তিনি বলেন,বিনিয়োগকারীদের আস্থার কথা বলতে গেলে ক্যাপিটাল মার্কেটে ভালো প্রোডাক্ট নাই। ভালো প্রোডাক্ট বন্ড, ট্রেজারি বিল বাজারে এসেছে। এগুলো নিরাপদ। কিন্তু এগুলোতে কেন বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করছে না? এগুলোতে মানুষের ঝোঁক কম এবং বিনিয়োগও কম। বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে ইতোমধ্যে আমরা ৬০ থেকে ৭০ হাজার কোটি টাকা সরকারের তহবিলে দিয়েছি। বন্ড মার্কেট এখন অর্থনীতিতে ভালো মতো ফান্ড দিচ্ছে। গারানকোর মতো প্রতিষ্ঠান আমাদের অনেক বন্ডকে গ্যারান্টি দিয়েছে।

ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ডের (সিএমএসএফ) চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের অগ্রগতির যে অদম্য অগ্রযাত্রা তার সঙ্গে তাল মেলাতে হলে পুঁজিবাজারকে আরও অনেক দূর এগোতে হবে। ভারতের মাথাপিছু আয় বাংলাদেশের প্রায় কাছাকাছি। কিন্তু ভারতের পুঁজিবাজারের সাইজ অনেক বড়। কারণ মাথাপিছু আয় ছাড়াও আরেকটা বিষয় যে ক্যাপিটাল মার্কেটকে প্রভাবিত করে, তা হলো অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা।

তিনি বলেন, প্রাইমারি মার্কেটে এখন লিস্টেড কোম্পানিজের সংখ্যা কম, বাইরে ভালো পারফর্মেন্স করছে এমন ভালো কোম্পানির বাজারে আশার আগ্রহ কম। ইনস্টিটিউটশনাল বিনিয়োগকারী নেই বাজারে। অন্যদিকে বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতাও বাজারের পিছিয়ে থাকার কারণ। তবে এই আস্থাহীনতা কাটাতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা কাজ করে যাচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের বাজারে বিনিয়োগে আগ্রহী করে তুলতে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সিএমএসএফ ও এরকম একটি মাধ্যম।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) চেয়ারম্যান ড. হাফিজ মোহাম্মদ হাসান বাবু বলেন, আমাদের দেশের পুঁজিবাজারের মূল অসুবিধা হলো তারল্য সংকট, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ কম, বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা। আস্থাহীনতা কমাতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা যেতে পারে। মার্কেটের যে পতন চলছে তা দীর্ঘমেয়াদী নয়। আমরা ডিএসই এবং সিএসই এটা নিয়ে কাজ করছি।

তিনি বলেন, দেশের মাঝেও রোড শো ছড়িয়ে দিতে হবে, যেন লোকাল বড় বড় ইনভেস্টরদের পুঁজিবাজারে নিয়ে আসা যায়। বিনিয়োগকারীদের সুবিধার্থে লিটারেসি প্রোগ্রাম বাড়াতে হবে। বাংলাদেশে দুইটা গুরুত্বপূর্ণ মার্কেট হলো মানি আর ক্যাপিটাল। আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয় আমাদের দেশের মানি মার্কেট আর ক্যাপিটাল মার্কেট পুরোপুরি উল্টো। দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য পুঁজিবাজারের ওপর নির্ভর না হয়ে ব্যাংকের ওপর নির্ভর হয়ে পরছে সবাই।

ডিএসই চেয়ারম্যান আরও বলেন, এনবিআর এর থেকেও আমরা আশা করি লিস্টেড কোম্পানিগুলোর ওপর কর কমিয়ে দেওয়ার। যেন তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো স্বস্তিতে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারে এবং তা দেখে ভালো কোম্পানিগুলোও বাজারে আসতে আগ্রহী হয়ে উঠে। এছাড়াও রেগুলেটরি ইস্যুতে বিএসইসি বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে।

চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহিম বলেন, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য শক্তিশালী পুঁজিবাজার ভূমিকা রাখবে। আর পুঁজিবাজারকে শক্তিশালী করতে সরকার অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য বাজার দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ এবং বন্ড ইস্যু করতে পারে। এছাড়াও করপোরেট গভর্নেন্সের দিকে নজর দেওয়া যেতে পারে। মানি মার্কেট এবং ক্যাপিটাল মার্কেট দুই জায়গাতেই করপোরেট গভর্নেন্সের অভাব রয়েছে।

তিনি বলেন, মার্কেটে আরো ডেপথ ক্রিয়েট করতে হবে। ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরের দিকে আমাদের মনোনিবেশ করা উচিৎ। দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের মাধ্যম ব্যাংক নির্ভর হতে পারে না।

এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের চেয়ারম্যান এসএস পারভেজ তমাল বলেন, ব্যাংক স্বল্পমেয়াদী ইনভেস্টমেন্টের জায়গা এবং পুঁজিবাজার লং টাইম ইনভেস্টমেন্টের জায়গা। প্রবাস জীবনে আমি যখন দেশের বাইরে ছিলাম তখন এটাই জানতাম। কিন্তু বাংলাদেশে এসে দেখি এটার উল্টোটা হচ্ছে। ইউরোপ থাকাকালে দেখেছি ইউরোপের মানুষের সঞ্চয়ের একটা বড় অংশই ক্যাপিটাল মার্কেটে বিনিয়োগ করে।

পারভেজ তমাল বলেন, ব্লু চিপের ইনডেক্সের উপরে ঐ দেশের বাজারের অবস্থা বোঝা যায়। আমাদের পুঁজিবাজারের সব ব্লু চিপ কোম্পানি ফ্লোর প্রাইজে পরে আছে। এটা আমাদের জন্য হতাশাজনক। তবে এই যুদ্ধ পরিস্থিতিতেও সুযোগ আছে আমাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার। প্রধানমন্ত্রীর রোডম্যাপ এবং রেগুলেটরের নেতৃত্ব বৈদেশিক বিনিয়োগ আনার কাজ চলমান থাকলে অগ্রগতি সম্ভব।

অ্যাসোসিয়েশন অফ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিজ অ্যান্ড মিউচুয়াল ফান্ডের (এএএমসিএমএফ) চেয়ারম্যান হাসান ইমাম বলেন, এখন আমরা রাশিয়া-ইউক্রেন ক্রাইসিস মোমেন্ট অতিবাহিত করছি, এর আগেও এমন কয়েকটি ক্রাইসিস পার করতে হয়েছে। বর্তমান সময়ের সংকটে ডলার ক্রাইসিস তৈরি হয়েছে। যার প্রভাব প্রায় সব কোম্পানির ওপর পড়েছে।

তিনি বলেন, ফ্লোর প্রাইসের জন্য তারল্য সংকট তৈরি হয়েছে। যুগে যুগে এমন অনেক ক্রাইসিস মোমেন্ট এসেছে, কিন্তু যখন এ ক্রাইসিস কেটে যায় তখন কিন্তু বিনিয়োগকারীরা বড় পরিসরে লাভবান হয়

শেয়ার দিয়ে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন...