আলোচনা-সমালোচনার মুখে অবশেষে সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবই থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে আলোচিত ‘শরীফার গল্প’ পাঠটি। বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এই পাঠটি বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগামী শিক্ষাবর্ষের বইয়ে এই গল্পটির পরিবর্তে অন্য কোনো গল্প সংযোজন করার নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি এক চিঠিতে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডকে (এনসিটিবি) এই নির্দেশনার কথা জানায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে শিক্ষাবিদরা বলছেন, এই গল্পটি বাদ দিলেও তৃতীয় লিঙ্গ নিয়ে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্য তাদের ওপর পাঠ রাখা উচিত।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গল্পটি নিয়ে বিতর্ক ওঠার পর তা পর্যালোচনার জন্য ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আব্দুর রশীদকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের একটি উচ্চপর্যায়ের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি ওই কমিটি মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনে তারা গল্পটির বিভিন্ন তথ্য নিয়ে আপত্তি জানিয়ে বাদ দেওয়ার সুপারিশ করে। কমিটির সুপারিশের আলোকে গল্পটি বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় থেকে এনসিটিবিতে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী ‘এই গল্পের পরিবর্তে অন্য আরেকটি গল্প সংযোজন করার জন্য জেন্ডার বিশেষজ্ঞগণের কাছ থেকে মতামত নেওয়া যেতে পারে। এবং গল্পের পরিবর্তে সংশোধিত গল্প সংযোজন করার ব্যবস্থা নিন।’
ঘটনার প্রেক্ষাপট
নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী সপ্তম শ্রেণির ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ বইয়ের একটি অধ্যায়ে যুক্ত করা হয়েছে হিজড়া জনগোষ্ঠী সম্পর্কে একটি জনসচেতনতামূলক পাঠ। ‘মানুষে মানুষে সাদৃশ্য ও ভিন্নতা’ বিষয়ক অধ্যায়ের ‘শরীফার গল্প’ শিরোনামে একটি গল্প ছাপা হয়।
চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি রাজধানীর কাকরাইলে ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সে ‘বর্তমান কারিকুলামে নতুন পাঠ্যপুস্তক : বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক সেমিনারের আলোচক ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক আসিফ মাহতাব উৎস সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের ‘শরীফার গল্প’ নিয়ে আলোচনার দাবি করেন, পাঠ্যবইয়ের ওই অংশ ‘রূপান্তরকামী’ এবং ‘সমকামিতাকে’ উসকে দিচ্ছে। এ সময় তিনি বইটির দুটি পৃষ্ঠা ছিঁড়ে ফেলেন।
এই ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে দেশজুড়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। ওই সময় এনসিটিবিসহ সংশ্লিষ্টরা বলেন, ‘শরীফার গল্প’ জনসচেতনতামূলক গল্প। এ কাহিনীতে দেশের সংবিধানস্বীকৃত ‘তৃতীয় লিঙ্গের’ মানুষ বা ‘হিজড়াদের’ জীবনের গল্প সুনিপুণভাবে তুলে আনা হয়েছে। অথচ একটি গোষ্ঠী উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে এ নিয়ে বিতর্ক ছড়াচ্ছে। এই বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চপর্যায়ের বিশেষজ্ঞ কমিটি করে মন্ত্রণালয়।
সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন
শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা বলছেন, পাঠ্যবই থেকে কোনো গল্প বাদ দেওয়া বা বই প্রত্যাহার করে নেওয়ার বিষয়টি নতুন নয়। এর আগেও একাধিকবার করা হয়েছে। এছাড়া বইয়ে ভুলবিভ্রান্তি থাকছে। তাই সংশ্লিষ্টদের উচিত বই প্রকাশের আগে ভালোভাবে গবেষণা ও সম্পাদনা করা। অন্যথায় পাঠ্যবই ও কারিকুলাম নিয়ে মানুষের মাঝে ভুল বার্তা ছড়াবে।
এর আগে নানা বিতর্কের মুখে ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে প্রণীত ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের বই প্রত্যাহার করে সরকার। তারও আগে ২০১৮ সালে বিতর্কিত তথ্য থাকায় মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের সপ্তম শ্রেণির ‘আল আকায়েদ ওয়াল ফিক্হ’, অষ্টম শ্রেণির ‘আল আকায়েদ ওয়াল ফিক্হ’ নবম ও দশম শ্রেণির ‘কুরআন মাজিদ ও তাজভিদ’ ও ‘হাদিস শরিফ’ বই বাতিল করা হয়। এছাড়া চলতি শিক্ষাবর্ষের ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির ৩১টি বইয়ের ১৪৭টি ভুল ধরা পড়ে। আর ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ৪টি বইয়ে ৫৮টি অসঙ্গতি আর ১৮৮টি ভুল খুঁজে বের করা হয়।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব ও জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির (নায়েম) সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক শেখ ইকরামুল কবির বলেন, অতি উৎসাহী ও অতি প্রগতিশীল লোকদের কারণেই এসব ঘটনা ঘটছে। তাদের উদ্দেশ্য পাঠ্যবইয়ে নিজের চিন্তাভাবনাকে প্রতিষ্ঠিত করা। পাঠ্যবইয়ের লেখকদের নির্বাচনের ক্ষেত্রে সরকারকে আরও সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, যারা বিভ্রান্তি ছড়াতে চায়, তাদের সংখ্যা খুবই কম। কিন্তু তারা এমনভাবে লেগে থাকে যে, তাদের দ্বারা আমরা প্রভাবিত হই। এসব বিতর্ক এড়াতে সরকারের আরও কঠোর হওয়া উচিত।
জাতীয় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও পরিমার্জন কোর কমিটি সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এম তারিক আহসান বলেন, শরীফার গল্পে মূলত তৃতীয় লিঙ্গের বিষয়টি সামনে আনার চেষ্টা করা হয়েছে। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের আমাদের সংবিধান স্বীকৃতি দিয়েছে, তারা আমাদের দেশের নাগরিক। তবে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তারা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন। আমরা যদি তাদের দূরে রাখি তাহলে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হবে না। এই উদ্দেশ্যে কারিকুলামে শরীফার গল্প পাঠটি রাখা হয়। যেহেতু বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে, তাই গল্পটি বাদ না দিয়ে আরও সংশোধন করে তৃতীয় লিঙ্গের বিষয়টি যাতে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় সেভাবে রাখা উচিত।
এনসিটিবির চেয়ারম্যান (চলতি দায়িত্ব) অধ্যাপক মশিউজ্জামান বলেন, এই বিষয়ে একটি চিঠি আমরা পেয়েছি। চিঠির আলোকে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।