রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে কিছুদিন ধরে রেলে নাশকতার ঘটনা বেড়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন রুটে রাতে চলাচলকারী কিছু ট্রেন হঠাৎ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বন্ধের পাশাপাশি রেলপথে নিরাপত্তা জোরদার করেছে। তবে ট্রেন বন্ধ হওয়ায় দুর্ভোগে পড়েছেন এসব রুটে চলাচলকারী সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে গরিবের ট্রেনখ্যাত দিনাজপুরে পার্বতীপুর থেকে রাজশাহীগামী উত্তরা এক্সপ্রেস ট্রেনটি গত শুক্রবার থেকে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভোগান্তি বেড়েছে। কারণ চিকিৎসা ও শিক্ষার জন্য উত্তরাঞ্চলের মানুষ কম টাকার ভাড়ার এ ট্রেনের ওপরে ভরসা করতেন বেশি। এ ছাড়া মালপত্র পরিবহনেও দেখা দিয়েছে সংকট।
উত্তরা এক্সপ্রেস ট্রেন বন্ধ হওয়ায় দুর্ভোগে পড়েছেন জয়পুরহাট, নাটোরের যাত্রীরাও। বিশেষ করে যারা এই ট্রেনে রাজশাহী-দিনাজপুরসহ আশপাশের জেলা ও উপজেলাতে অফিস করতে আসতেন তাদের দুর্ভোগের শেষ নেই। পশ্চিমাঞ্চল রেলের প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা সুজিত কুমার বলেন, উত্তরা এক্সপ্রেস গভীর রাতে পার্বতীপুর থেকে ছেড়ে আসত। নাশকতার আশঙ্কায় আপাতত পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত ট্রেনটি চলাচল বন্ধ থাকবে। পরিবেশ অনুকূলে এলে ট্রেন আবার চালু করা হবে।
একই কারণে শুক্রবার থেকে বন্ধ রাখা হয়েছে পাবনার ঈশ্বরদী থেকে রাজশাহী হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুরের মধ্যে চলাচল করা আই আর লোকাল ট্রেন। এ ছাড়া টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর থেকে রাত্রিকালীন ময়মনসিংহগামী ৩৭ আপ মেইল ট্রেনটিও গত ১৮ ডিসেম্বর থেকে বন্ধ রয়েছে। আন্তঃনগর যমুনা এক্সপ্রেস ট্রেনটি ঢাকার কমলাপুর থেকে জামালপুরের তারাকান্দি আর ‘নাসিরাবাদ’ নামে একটি লোকাল ট্রেন চট্টগ্রাম থেকে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর পর্যন্ত চলাচল করত। গত ১৫ ডিসেম্বর থেকে ট্রেন দুটি আর নিজ গন্তব্যে যাচ্ছে না। ট্রেন দুটির বর্তমান গন্তব্য কেবল জামালপুর রেলওয়ে জংশন স্টেশন। ফলে এসব ট্রেন ব্যবহারকারীরাও চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। বাধ্য হয়ে তাদের বেশি ভাড়া দিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে সড়ক পথে।
ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটেও এক জোড়া ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ স্টেশনমাস্টার কামরুল ইসলাম জানান, আগে এ রুটে আট জোড়া ট্রেন চলত। এখন সাত জোড়া ট্রেন চলছে। রাত ১০টায় চলাচল করা এক জোড়া ট্রেন বন্ধ রাখা হয়ে।
এদিকে রেলপথে নাশকতা রুখতে স্টেশন ও রেললাইনের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে যে সাত জোড়া ট্রেন চলছে তার নিরাপত্তায় বগিগুলোর ভেতরে ও পুরো লাইন পাহারায় ৭০ জন আনসার নিয়োগ করা হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন থানার পুলিশও রেললাইনগুলোতে যাওয়া যায় এমন প্রবেশপথে টহল দিচ্ছে। আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর জামালপুর জেলা কমান্ড্যান্ট মিজানুর রহমান জানান, জামালপুর জেলার ১১২ কিলোমিটার রেললাইনের ৬১টি পয়েন্টে ৩৬৬ জন আনসার ভিডিপি সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। পিয়ারপুর থেকে দেওয়ানগঞ্জ ও সরিষাবাড়ীর তারাকান্দি পর্যন্ত দুই কিলোমিটার পরপর ৬ জন করে আনসার ও ভিডিপি সদস্য রেললাইন পাহারা দিচ্ছেন।
ঈশ্বরদী রেলওয়ে জংশন স্টেশনের সুপারিনটেনডেন্ট মহিবুর রহমান বলেন, দেশের সবচেয়ে বড় রেলওয়ে জংশন ঈশ্বরদী। এ স্টেশন ঘিরে এর আগে কয়েকটি নাশকতার ঘটনার কারণে আমরা আগের চেয়ে আরও সতর্ক রয়েছি। পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে ম্যানেজার শাহ সূফি নূর মোহাম্মদ বলেন, আনসার সদস্য বাড়ানো হয়েছে, নিরাপত্তা বাহিনীকে আরও কঠোরভাবে দায়িত্ব পালন করতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি শুরু করা হয়েছে স্টেশনের চারপাশে নিরাপত্তা দেয়াল নির্মাণের কাজও।
সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার স্টেশনগুলোতেও নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। গত শুক্রবার সিলেট স্টেশনে র্যাডব-৯ এর অধিনায়ক উইং কমান্ডার মোমিনুল হক জানান, স্টেশনগুলোতে নিয়মিতভাবে র্যা ব টহল দিচ্ছে। নাশকতাকারী ও দুষ্কৃতকারীরা যেন কোনো প্রকার দাহ্য পদার্থ, বিস্ফোরক কিংবা অবৈধ মালপত্র বহন করতে না পারে সেজন্য স্টেশন এলাকা ও গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে চেকপোস্ট পরিচালনা করা হচ্ছে। বিভিন্ন রেলে র্যা ব-৯ এর বম্ব ডিসপোজাল ইউনিট নিয়মিত সুইপিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সাদা পোশাকে বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারি।
নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন রুটে ট্রেন বন্ধ করা প্রসঙ্গে যাত্রী অধিকার ফোরামের আহ্বায়ক রফিউর রাব্বি বলেন, ‘নির্বাচন সামনে রেখে নাশকতার শঙ্কায় ট্রেন বন্ধ করা হয়েছে। এটিতে অসুবিধা হলেও মেনে নিতে হবে। কিন্তু বিষয়টি যাতে এমন না হয় যে, বন্ধ করা ট্রেন আর চালুই করা হলো না। এর আগে পদ্মা সেতুসংশ্লিষ্ট কাজের জন্য ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটের ট্রেন বন্ধ করা হয় তিন মাসের জন্য। কিন্তু আট মাস পর আমাদের আন্দোলনের মুখে এ রুটের ট্রেন চালু হয়। আমরা নির্বাচন পর্যন্ত দেখব। এর পরও ট্রেন বন্ধ করে রাখলে আমরা আন্দোলনে যাব।’
এদিকে গত শুক্রবার বিকেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রেললাইন থেকে প্যান্ডেল ক্লিপ খোলার সময় আরিফ মিয়া নামে এক যুবককে আটক করেন আনসার সদস্যরা। রাতেই তাকে পুলিশে হস্তান্তর করা হয়। আখাউড়া রেলওয়ে থানার ওসি নূরে আলম জানান, নাশকতা চেষ্টার মামলায় আরিফকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে শনিবার তাঁকে আদালতে পাঠানো হয়েছে।
নাটোরে রেললাইনে নাশকতা সন্দেহে গতকাল শনিবার কিছু সময় ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখা হয়। সকাল ৬টার দিকে খুলনাগামী একটি মালবাহী ট্রেন বাসুদেবপুর ঋষিপাড়া অতিক্রমকালে বিকট শব্দ ও জোরে ঝাঁকুনি খায়। ঘটনাস্থলে গিয়ে ট্রেনের লোকজন দেখেন, লাইনের কিছু অংশ কাটা। এই খবরে নাটোর স্টেশনে আসা রাজশাহী থেকে চিলাহাটীগামী আন্তঃনগর তিতুমীর এক্সপ্রেস ট্রেন আটকে দেওয়া হয়। পরে বিষয়টি দেখতে রেল কর্তৃপক্ষের পাঠানো জালাল উদ্দিন নামে একজন কী-ম্যান ঘটনাস্থলে যান। সান্তাহার রেলওয়ে থানার একটি টিম ঘটনাস্থলের উদ্দেশে রওনা হয়। পরীক্ষা করে কী-ম্যান জানান, রেললাইনের জোড়া স্থানের ওয়েলডিং উঠে যাওয়ার কারণে এমনটি হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর পর লাইনের ক্ষতিগ্রস্ত স্থানে চটের বস্তা দিয়ে তিতুমীর ট্রেনটি পার করে দেওয়া হয়।