সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২৪

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এ্যাড. রাণা দাশগুপ্তের নেতৃত্বে ৫ সদস্যবিশিষ্ট এক প্রতিনিধিদল আজ সকাল ১১টায় নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের কাছে এক স্মারকলিপি প্রদান করেছে। কমিশনের অপর চার সদস্য যথা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আহসান হাবিব খান, বেগম রাশেদা সুলতানা, মোঃ আলমগীর এবং মোঃ আনিছুর রহমান এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

প্রায় এক ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে পঠিত ঐক্য পরিষদের স্মারকলিপিতে বলা হয়, আগামী ২০২৪ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সে অর্থে সংসদ নির্বাচনের আর মাত্র তিন মাস বাকি। এই নির্বাচনকে সামনে রেখে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীন স্বার্বভৌম বাংলাদেশ আজ পরাশক্তিসমূহের কূটনৈতিক যুদ্ধক্ষেত্র হিসাবে পরিণত হওয়ায় এদেশের ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় শঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন। আশা করতে চাই, উৎসব ও আনন্দমুখর পরিবেশে এ দেশের সকল রাজনৈতিক দল ও জোট আসন্ন সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে এবং দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর করে তুলবে।

স্মারকলিপিতে গভীর দুঃখের সাথে বলা হয়, সকলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে আশাবাদী হলেও অতীত এ দেশের ধর্মীয় ও জাতিগত আড়াই কোটি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর জন্যে মোটেই সুখকর ছিল না। একদিকে জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে সংসদে তাদের যথাযথ অংশীদারিত্ব-প্রতিনিধিত্ব থাকেনি, অন্যদিকে নির্বাচনে ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু নারী-পুরুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করতে পারেনি। নির্বাচনে ব্যক্তিস্বার্থে, গোষ্ঠীস্বার্থে ও রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতাকে নির্বাচনী প্রচারণায় যদৃচ্ছভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। অতীতে দেখা গেছে, প্রায় সকল ধরনের নির্বাচনে রাজনৈতিক দলসমূহের একাংশ স্লোগান দেয় ‘জয় বাংলা জয় হিন্দ লুঙ্গি খুইল্লা ধুতি পিন্দ’, ‘শেখ হাসিনার বাপের নাম হরে কৃষ্ণ হরে রাম’, ‘হিন্দু যদি বাঁচতে চাও বাংলা ছেড়ে চলে যাও’। রাজনৈতিক দলের আরেকাংশ নির্বাচনী প্রচারণায় হিন্দু এলাকায় যাওয়ার সময় শ্লোগান দেয় ‘জয় বাংলা’ আবার মুসলিম এলাকায় যাওয়ার সময় শ্লোগান তোলে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ নৌকার মালিক তুই আল্লাহ’। নির্বাচনের পূর্বাপর ব্যক্তি হিসেবে নয়, সংখ্যালঘু হিসেবে টার্গেট করে তাদের উপর নির্বিচারে নিপীড়ন, নির্যাতন চালানো হয়, ঘর-বাড়ী উপাসনালয়ে হামলা চালানো হয়, জোরপূর্বক দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়। এ ধরনের অসুস্থ কদর্যকর রাজনৈতিক বাতাবরণ তৈরী করে সংখ্যালঘুদের নির্ভয়ে নির্বিঘ্নে ভোটদানে বাধা দেয়া হয়।

স্মারকলিপিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলা হয়, ইতোমধ্যে আমরা লক্ষ্য করেছি স্বার্থান্বেষী সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী সামাজিক ও রাজনৈতিক চক্র শারদীয় দুর্গোৎসবের আগে নানান জায়গায় মঠ-মন্দিরে, উপাসনালয়ে আবারো হামলা শুরু করেছে, মূর্তি ভাংচুর অব্যাহত রেখেছে।

স্মারকলিপিতে এদেশের দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর নির্ভয়ে নির্বিঘ্নে নিজ নিজ পছন্দের প্রার্থীকে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটদানে আগ্রহের কথা ব্যক্ত করে ৯টি দাবি তুলে ধরে বলা হয়, আপনার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের উপর আমরা পরিপূর্ণ আশা ও আস্থা রাখতে চাই। এটাও সত্য যে অতীতে আমরা নির্বাচন কমিশনের উপর আস্থা রেখে হতাশ হয়েছি। ভবিষ্যতে এ হতাশার চোরাবালিতে আমাদের আর নিক্ষেপ হতে হবে না- এ আশা রাখতে চাই। এই আশা ও আস্থা পরিপূরণে কমিশন দক্ষতা, নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতার সাথে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা করবে এবং collective political wisdom  সম্পন্ন পার্লামেন্ট গঠনে সার্থক ভূমিকা পালন করবে, এ আশা ব্যক্ত করছি।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার প্রদত্ত স্মারকলিপি গ্রহণ করে এর প্রতিটি বক্তব্য ও দাবির সাথে ঐক্যমত পোষণ করে বলেন, সারাদেশে মানবিক মূল্যবোধের তীব্র অভাব দেখা দিয়েছে। সাম্প্রদায়িকতা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। জনগণের মনস্তাত্ত্বিক বিষয় উন্নয়নের দায়িত্ব রাজনৈতিক দলের। এর পরেও রাজনৈতিক-সাম্প্রদায়িক সহিংসতামুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের প্রতিনিধিদলে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন- সংগঠনের প্রেসিডিয়াম সদস্য রঞ্জন কর্মকার, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনীন্দ্র কুমার নাথ ও জয়ন্ত কুমার দেব এবং উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য, সাবেক জেলা প্রশাসক দেবাশীষ নাগ।

স্মারকলিপিতে উল্লেখিত দাবিসমূহ হলো:
১. সংসদীয় নির্বাচন সর্বসময়ের জন্যে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার তাগিদে ভারতের নির্বাচন কমিশনের অনুরূপ বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনকে অধিকতর শক্তিশালী ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের তাগিদে সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে যথাযথ সুপারিশমালা প্রেরণ;

২. নির্বাচনী ব্যালটে ‘না’ ভোটের ব্যবস্থা করা যাতে সংসদকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের নিমিত্তে নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নে রাজনৈতিক দল ও জোটসমূহ সতর্ক ভূমিকা পালন করে;

৩. ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু ভোটাররা যাতে নির্বিঘ্নে ভোটকেন্দ্রে যেতে পারে, প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে কোনোরকম বাধার সম্মুখীন না হয় এবং নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণে সমান সুযোগ পায় তার জন্যে নির্বাচন কমিশনকে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরী করে ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টি করা;

৪. নির্বাচনী প্রচারণায় ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতার ব্যবহার নিষিদ্ধ করা। যদি কোনো প্রার্থী বা কোনো দল নির্বাচনে ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতাকে ব্যবহার করে তবে তার শাস্তির বিধান রাখা;

৫. নির্বাচনের পূর্বাপর সময়কালে ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং জননিরাপত্তা, আইন-শৃংখলাজনিত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের তাগিদে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকাগুলোকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে পুলিশ, আনসার ইত্যাদি মোতায়েনের পাশাপাশি র‌্যাব, বিজিবি-র নিয়মিত টহলদানের ব্যবস্থা করা এবং নিয়মিত মনিটরিং করার জন্য একটি ‘মনিটরিং সেল’ গঠন করা;

৬. নির্বাচন কমিশন কর্তৃক সংখ্যালঘু নিরাপত্তায় গৃহীত যাবতীয় পদক্ষেপের বিষয়ে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, নির্বাচনসংশ্লিষ্ট সকল আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্য, রাজনৈতিক দল ও জোটের নেতৃবৃন্দ, নির্বাচনের প্রার্থীসহ প্রার্থীর সমর্থক সকলকে সম্যকভাবে তা অবহিত করা। রেডিও, টেলিভিশনে তা জনগণের জ্ঞাতার্থে প্রচার করা;

৭. সকল ধর্মীয় উপাসনালয় যথা- মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা, গীর্জা নির্বাচনী প্রচার কাজে ব্যবহার নিষিদ্ধ করা;

৮. ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক বক্তব্য, বিবৃতি, মিথ্যা গুজব প্রচার বা এ ধরনের যাবতীয় প্রচারণা বিশেষ ক্ষমতা আইনের 2(f)(iv) 2(f)(vii) ধারায় Prejudicial act  বা ক্ষতিকর কার্য হিসেবে অপরাধ গণ্যে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। একই সাথে তাৎক্ষণিকভাবে দায়ী ব্যক্তিদের প্রার্থিতা বাতিলের ব্যবস্থা করা;

৯. নারী সমাজের মতোই দেশের ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন সুনিশ্চিত করার লক্ষে তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত সকল রাজনৈতিক দলের কাঠামোতে অন্যূন ২০% সংখ্যালঘু প্রতিনিধিত্ব গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে সংযোজনের এবং যুক্ত নির্বাচনের ভিত্তিতে সংসদে সংখ্যালঘুদের জন্যে ৬০টি আসন সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া।

আগামীকাল ১২ অক্টোবর ২০২৩ বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাথে কমিশন কার্যালয়ে (বিটিএমসি ভবন, ৯ম তলা, কাওরানবাজার) বৈঠক করবে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ।

শেয়ার দিয়ে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *