নভেম্বর ১৪, ২০২৪

সরকারি কেনাকাটায় অনিয়ম, প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের শূন্য সহনশীল নীতি কার্যকর না হওয়া, অর্থ পাচারসহ নানা কারণে দেশে অস্বাভাবিক মাত্রায় বেড়েছে দুর্নীতি। বার্লিনভিত্তিক দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) প্রকাশিত দুর্নীতির ধারণা সূচক (সিপিআই)-২০২৩-এ বাংলাদেশে দুর্নীতি উদ্বেগজনক হারে বাড়ার চিত্রই ফুটে উঠেছে। এবার দুই ধাপ অবনতি হয়ে ১৮০ দেশের মধ্যে নিম্নক্রম অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান দশম। স্কোরও ১ পয়েন্ট কমে হয়েছে ২৪।

গতকাল মঙ্গলবার আন্তর্জাতিকভাবে এই সূচক একযোগে প্রকাশ করা হয়। একই দিনে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বাংলাদেশের দুর্নীতির সূচক প্রকাশ করে। এবার টিআই সূচকের প্রতিপাদ্য ছিল ‘দুর্নীতি ও অবিচার’। এবারের সূচকে ৯০ স্কোর পেয়ে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকার শীর্ষে আছে ডেনমার্ক। একই সঙ্গে ১১ স্কোর পেয়ে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হয়েছে সোমালিয়া। রাজধানীর ধানমন্ডির মাইডাস ভবনের টিআইবি কার্যালয়ে গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের দুর্নীতির ধারণা সূচক তুলে ধরেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। টিআইবি বলেছে, দুর্নীতির ধারণা সূচকে স্কোর ও অবস্থানের এই অবনমন প্রমাণ করে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীল নীতি ঘোষণাসহ সরকারের বিভিন্ন অঙ্গীকার-সূচকের তথ্যের সময়কালে বাস্তবিক অর্থে কার্যকর প্রয়োগ হয়নি; বরং আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতায় বাংলাদেশের অবস্থানের আরও অবনতি হয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে কার্যকরভাবে সব ধরনের দুর্নীতির অপরাধের শাস্তি এবং ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত করতে পাঁচ দফা সুপারিশ করেছে টিআই।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, এই মেয়াদে বাংলাদেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা ঘনীভূত ও বিস্তৃত হয়েছে। সরকারি কেনাকাটা, বিতরণ ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন কার্যক্রমে দুর্নীতির অসংখ্য তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। বিদেশে অর্থ পাচারের আশঙ্কাজনক চিত্র উঠে এলেও এর প্রতিরোধ ও প্রতিকারে দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ঋণখেলাপি, জালিয়াতি ও অর্থ পাচারে জর্জরিত ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি; বরং এর জন্য যারা দায়ী, তাদের জন্য বিচারহীনতার পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি দমনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতে কার্যকারিতা দেখাতে পারেনি। রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, আর্থিকসহ বিভিন্নভাবে অর্জিত ক্ষমতার অবস্থানকে অপব্যবহারের মাধ্যমে সম্পদ বিকাশের লাইসেন্স হিসেবে ব্যবহারের ব্যাপকতা বেড়েছে।

ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুর্নীতির ধারণা সূচক অনুযায়ী ২০২৩ সালের বাংলাদেশের স্কোর ২৪, যা গত ১২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এ স্কোর ২০২২ সালে ছিল ২৫। সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন দুই ধরনের স্কেরের হিসাবেই ২০২২ সালের চেয়ে ২০২৩ সালে বাংলাদেশের অবস্থান দুই ধাপ অবনমন হয়েছে। সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় নিম্নক্রম ও ঊর্ধ্বক্রম অনুযায়ী অবস্থানের দুই ধাপ অবনতি হয়ে যথাক্রমে দশম ও ১৪৯তম হয়েছে। গেল ২০২২ সালে যা ছিল যথাক্রমে ১২ ও ১৪৭।

সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক বলেন, দুর্নীতির গভীরতা শুধু বাংলাদেশে নয়; অনেক উন্নত, ভালো দেশে স্কোর কমে দুর্নীতির ব্যাপ্তি বেড়েছে। তবে বাংলাদেশে সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় সর্বত্র দুর্নীতি উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। টিআইর উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, দুর্নীতির সঙ্গে অবিচারের একটি অন্তর্নিহিত সম্পর্ক রয়েছে। অবিচার হলে দুর্নীতি বাড়ে; আর দুর্নীতি বাড়লে অবিচার বাড়ে। গণতন্ত্রের অবক্ষয়, স্বৈরাচারী, বিচারহীনতার কারণে দুর্নীতির গভীরতা বেড়েছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের শূন্য সহনশীল নীতি বাস্তবায়ন করা হয়নি। এটি মৌখিক ঘোষণামাত্র। সরকারি কেনাকাটা ও প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্নীতি বেড়েছে ব্যাপক হারে। অর্থ পাচারকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আন্তর্জাতিক সূচকে অর্থ পাচারে বাংলাদেশ শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। স্বজনপ্রীতি, দলীয়ভাবে নেতিবাচক রাজনৈতিক প্রভাব ছিল সর্বত্র। যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ, তাদের মুখ দেখে আইনের আওতায় আনা হয়নি। উল্টো যারা ভিকটিম, তাদের আইনের কাছে সোপর্দ করা হয়েছে। দুর্নীতি কমিয়ে আনতে বা দূর করতে সরকারের অঙ্গীকারগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দুদক নিজের ইচ্ছামতো স্বাধীনভাবে দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রম চালাতে পারছে না। কোথায় যেন দুদকের হাত-পা বাঁধা। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে সরকারের উন্নয়ন আরও কার্যকর হতো।

টিআইবি পর্ষদ চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, তারা (সরকার) নিজেরাই অঙ্গীকার করেছে দুর্নীতি কমাবেন, দুর্নীতি দূর করবেন। এ কথা তারা সৎভাবে বলেছেন কিনা, সেটি দেখার বিষয়। ২০১২ থেকে ২০২৩ সালের টিআই সূচক বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বাংলাদেশের এবারের স্কোর ১২ বছরের গড় স্কোর ২৬-এর চেয়ে ২ পয়েন্ট কম।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, সূচকে সর্বোচ্চ ৯০ স্কোর পেয়ে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকার শীর্ষে আছে ডেনমার্ক। ৮৭ স্কোর নিয়ে দ্বিতীয় ফিনল্যান্ড এবং ৮৫ স্কোর পেয়ে তৃতীয় নিউজিল্যান্ড। এদিকে ১১ স্কোর পেয়ে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ সোমালিয়া। ১৩ স্কোর পেয়ে নিম্নক্রম অনুযায়ী যৌথভাবে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে দক্ষিণ সুদান, সিরিয়া ও ভেনেজুয়েলা এবং ১৬ স্কোর পেয়ে তৃতীয় সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে ইয়েমেন। ১৮০ দেশের মধ্যে ১০৫ দেশ বৈশ্বিক গড় ৪৩-এর কম স্কোর করেছে। অর্থাৎ বিশ্বের ৮০ শতাংশ জনগোষ্ঠীই গড় স্কোর ৪৩-এর কম পেয়ে সূচকের শ্রেণিবিভাগ অনুযায়ী চরম উদ্বেগজনক দুর্নীতির মধ্যে বাস করছে। আর সূচকে অন্তর্ভুক্ত দুই-তৃতীয়াংশের বেশি ১২২ দেশের স্কোর ৫০-এর নিচে। এর অর্থ, ওই সব দেশে দুর্নীতির মাত্রা উদ্বেগজনক।

দুর্নীতির ধারণা সূচকে আরও বলা হয়, ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের গবেষণা অনুযায়ী ২৪টি পূর্ণ গণতান্ত্রিক, ৪৮টি ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক, ৩৬টি হাইব্রিড গণতান্ত্রিক ও ৫৯টি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের গড় স্কোর সিপিআই যথাক্রমে ৭৩, ৪৮, ৩৬ ও ২৯। অথচ বাংলাদেশের স্কোর ২৪। এমনকি ফ্রিডম হাউস অনুযায়ী যেসব দেশে নির্বাচনী গণতন্ত্র আছে, এমন ৯৩টি রাষ্ট্রের গড় স্কোর ৫৩ এবং নির্বাচনী গণতন্ত্রহীন রাষ্ট্রগুলোর স্কোর ৩১। এ ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের স্কোর ২৪, যা উদ্বেগজনক ও বিব্রতকর।

দক্ষিণ এশিয়ার আট দেশের মধ্যে ভুটান গত বছরের ৬৮ স্কোর ধরে রাখলেও এ অঞ্চলের পাঁচটি দেশ এবার ২০২২ সালের চেয়ে কম স্কোর করেছে। বাকি দুটি দেশের স্কোর কিছুটা বেড়েছে। এর মধ্যে আফগানিস্তানের ৪ পয়েন্ট, শ্রীলঙ্কার ২ পয়েন্ট। একই সঙ্গে বাংলাদেশ, মালদ্বীপ ও ভারতের স্কোর ১ পয়েন্ট করে কমেছে। আর পাকিস্তানের ২ ও নেপালের ১ পয়েন্ট স্কোর বেড়েছে। তবে দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র ভুটান ছাড়া বাকি সাতটি দেশেরই সূচকের গড় স্কোর ৪৩-এর কম। অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ার জনসাধারণ সার্বিকভাবে চরম উদ্বেগজনক দুর্নীতির মধ্যে আছে।

এ ব্যাপারে দুদক মুখপাত্র ও সচিব মো. মাহবুব হোসেনের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি দুর্নীতির ধারণা সূচক-সংক্রান্ত টিআইর প্রতিবেদন না দেখে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

দুদকের আইনজীবী ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘আমরা টিআইর যে কোনো ডেটা এবং গঠনমূলক সমালোচনাকে স্বাগত জানাই। বাংলাদেশ নিয়ে টিআইর তথ্যগুলো সিরিয়াসলি আমলে নেওয়া হবে। দুর্নীতি দমনে সেভাবে কাজ করা হবে। দুদক এর আগে বড় বড় করপোরেশনের চেয়ারম্যান, অতিরিক্ত সচিব, সচিবের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। তখন সরকার কোনো বাধা দেয়নি। দুদকের স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষেত্রে সরকার কোনো প্রভাব খাটাচ্ছে না।

টিআই সূচকে দুর্নীতির ধারণার মাত্রাকে ০ (শূন্য) থেকে ১০০-এর স্কেলে নির্ধারণ করা হয়। ‘শূন্য’ স্কোরকে দুর্নীতির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ক্ষতিগ্রস্ত এবং ১০০ স্কোরকে দুর্নীতির সবচেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত বা সর্বাধিক সুশাসিত বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। সূচকে অন্তর্ভুক্ত কোনো দেশই এখন পর্যন্ত শতভাগ স্কোর পায়নি। অর্থাৎ দুর্নীতির ব্যাপকতা সর্বনিম্ন এমন দেশগুলোতে কম মাত্রায় হলেও দুর্নী

তি বিরাজ করে।

 

শেয়ার দিয়ে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন...