২০১৬ সালের ১ জুলাই হোলি আর্টিজান হামলায় নিহত সাত জাপানি নাগরিকের স্মরণে অনুষ্ঠিত স্মরণসভায় যোগ দিতে সম্প্রতি বাংলাদেশে এসেছেন জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হারা শোহেই। বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করাও তার এ সফরের অন্যতম উদ্দেশ্য।
গত বুধবার (৩ জুলাই) এ স্মরণসভার আয়োজন করেছে জাইকা। সফরকালে হারা শোহেই সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
জাইকার অংশীদারিত্বে চলমান ও শেষ হওয়া বিভিন্ন প্রকল্পে সহযোগিতার জন্য সাধুবাদ জানাতে এবং পরিকল্পিত প্রকল্পগুলো নিয়ে মতামত বিনিময়ে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তিনি।
এছাড়াও তিনি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী এবং মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. ফারহিনা আহমেদের সঙ্গে দেখা করে জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সীমিত করা, বনায়ন, বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে জাইকার অংশীদারিত্বমূলক কার্যক্রমের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি সক্ষমতা উন্নয়ন এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা ও জ্ঞান বিনিময়ের সুযোগ নিয়ে ধারাবাহিকভাবে কাজ করা ও আলোচনার আগ্রহ প্রকাশ করেন।
গত বৃহস্পতিবার (০৪ জুলাই) হারা শোহেই অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী এবং অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খানের সঙ্গে দেখা করেন। বৈঠকে তিনি জাইকার অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পে সহযোগিতামূলক কার্যক্রমের ওপর জোর দেন এবং বাংলাদেশের টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করার ক্ষেত্রে জাইকার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের সাথেও সাক্ষাৎ করেন হারা শোহেই। সাক্ষাতে তিনি পাওয়ার গ্রিডের স্থিতিশীলতা এবং সরকারি কর্মকর্তাদের সক্ষমতা উন্নয়নের ওপর আলোকপাত করে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প নিয়ে আলোচনা করেন এবং চলমান সহযোগিতার ক্ষেত্রে জাইকার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন।
এছাড়াও, সফরকালে তিনি বাংলাদেশ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (বিএসইজেড), ঢাকা এমআরটি লাইন ৬, হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল, খারুলিয়া তালিমুল কুরআন মাদ্রাসা, মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ প্রকল্প এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ একাধিক জাইকা-সমর্থিত প্রকল্প পরিদর্শন করেন।
গত ৩০ জুন হারা শোহেই আড়াইহাজারে বিএসইজেড পরিদর্শন করেন। সিঙ্গারের নতুন কারখানার কার্যক্রম পর্যবেক্ষণকালে তিনি বাংলাদেশে এফডিআই (প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ) প্রবাহ বৃদ্ধিতে বিএসইজেড’র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এবং শিল্পখাতে বৈচিত্র্য নিশ্চিতের ওপর আলোকপাত করেন। এছাড়াও, বিএসইজেড’র সর্বোচ্চ সুবিধা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও কাস্টমসসহ বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার নিরলস সহযোগিতা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
হারা শোহেই গত ১ জুলাই ঢাকা এমআরটি লাইন ৬ পরিদর্শন করে এ প্রকল্পকে একটি সফল দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতামূলক প্রকল্পের অনন্য উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, “ঢাকা এমআরটি জাইকার জাপানি আনুষ্ঠানিক উন্নয়ন সহযোগিতার (ওডিএ) সবচেয়ে সফল প্রকল্পগুলোর একটি এবং বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে বন্ধুত্ব ও আস্থার উজ্জ্বল উদাহরণ। দীর্ঘ এ যাত্রার শুরু থেকে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড এবং বাংলাদেশ সরকারের সাথে কাজ করতে পেরে জাইকা অত্যন্ত গর্বিত এবং সম্মানিত। ভবিষ্যতের এমআরটি লাইন প্রকল্পের ক্ষেত্রে আমরা আমাদের সহযোগিতা অব্যাহত রাখব।”
হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল পরিদর্শনকালে হারা শোহেই বলেন, “বর্তমানের প্রয়োজন পূরণ ও ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির ভবিষ্যৎ চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখবে এমন প্রকল্পে সহযোগিতা করার ক্ষেত্রে নিবেদিতভাবে কাজ করবে জাইকা। আমরা মনে করি, বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল ভবিষ্যতে অ্যাভিয়েশন খাতের জন্য উদ্ভাবন ও সক্ষমতার কেন্দ্রে পরিণত হবে, যা অর্থনৈতিক বিভিন্ন সুযোগ তৈরি করবে এবং আঞ্চলিক সংযোগ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে।”
গত ২ জুলাই মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ প্রকল্প পরিদর্শন করেন হারা শোহেই। কোভিড-১৯ এর বৈশ্বিক মহামারি ও ইউক্রেন যুদ্ধের মতো সঙ্কট সত্ত্বেও এ প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে প্রশংসা করেন তিনি। তিনি বলেন, মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ প্রকল্প বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতাকে শক্তিশালী করবে এবং একটি স্থিতিশীল ব্যবস্থায় বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিতে ভূমিকা রাখবে। মাতারবাড়ি ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় গভীর সমুদ্র বন্দর, সড়ক ও সেতুর উন্নয়নে জাইকার ভূমিকা দেশব্যাপী অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
এছাড়াও, তিনি কক্সবাজার সদর উপজেলার খারুলিয়া তালিমুল কোরআন মাদ্রাসা পরিদর্শন করেন। এ মাদ্রাসায় উপজেলা পরিষদ জাইকার সহযোগিতায় উপজেলা পরিচালন ও উন্নয়ন প্রকল্পের (ইউজিডিপি) অর্থায়নে নারী শিক্ষার্থীদের জন্য একটি স্কুল বাস প্রদান করেছে। এ সময় মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ দেশব্যাপী সকল উপজেলায় ইউজিডিপি’র ইতিবাচক কার্যক্রমের জন্য ইউজিডিপি’র প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে; পাশাপাশি, নারীদের জন্য শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধির ইতিবাচক প্রভাবের ওপর গুরুত্বারোপ করে।
এছাড়াও, হারা শোহেই বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের (বিএফএসএ) পরিদর্শন, নিয়ন্ত্রক ও সমন্বয় কার্যক্রম শক্তিশালীকরণ প্রকল্প পর্যবেক্ষণে নবাবী ভোজ রেস্তোরাঁ পরিদর্শন করেন। তিনি নমুনা সংগ্রহ ও তদারকি প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করেন এবং বিএফএসএ’র কর্মকর্তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির কার্যক্রমের প্রশংসা করেন।
এছাড়াও, গত ৪ জুলাই, হারা শোহেই হাসপাতালের দু’টি ওয়ার্ড দেখতে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। নার্সিং সেবা প্রকল্পের সক্ষমতা বৃদ্ধি অংশীদার হাসপাতালগুলোর নার্সিং শিক্ষার্থীদের ক্লিনিকাল নার্সিং অনুশীলন বাস্তবায়ন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। হারা শোহেই শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইমেজিং ডায়াগনস্টিক সেন্টারও পরিদর্শন করেন এবং নিরাপত্তা এবং মান ব্যবস্থাপনাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য নির্মাণ দলের প্রতি অনুরোধ জানান।
প্রি-পেইড গ্যাস মিটার প্রকল্পও ঘুরে দেখেন হারা শোহেই। প্রকল্পটি ব্যবহারকারীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করেছে; ফলশ্রুতিতে, গ্যাসের ব্যবহার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। পাশাপাশি, মাসিক খরচ কমে যাওয়ার কারণে গ্রাহক সন্তুষ্টিও বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রকল্পটি গ্যাস লিকেজ সনাক্তকরণ ও পরিবেশে মিথেন নির্গমন হ্রাসেও ভূমিকা রেখেছে।