ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২৫

বাংলাদেশে দুর্নীতির শিকড় অনেক গভীরে। বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় কতটা দুর্নীতি নির্মূল করা সম্ভব? দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশন থেকে যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তার কতটুকু বাস্তবায়ন সম্ভব? এসব বিষয় নিয়ে সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেনে, স্বাভাবিক অবস্থায় এটা আশা করা যায় কিনা সেটা নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে। এখনো সেই প্রশ্নটা আছে। এখন আমরা একটা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আছি। অনেক রক্তের বিনিময়ে এই অর্জন। ছাত্র-জনতার নেতৃত্বের এই আন্দোলনে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো এর অংশীদার বলে নিজেরা দাবি করছেন। যৌক্তিকভাবেই হয়তোবা। এই আন্দোলনের অংশ হিসেবে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন লাগবে।

বিজ্ঞাপন

এটা যদি হয়, তাহলে দুর্নীতি দমন কমিশন নিয়ে প্রত্যাশায় জায়গায় যাওয়া সম্ভব। এই শর্তে যে, আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে হবে। যে কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার অবস্থান ছিল, সেই কর্তৃত্ববাদ বিকাশের অন্যতম স্তম্ভ ছিল দুর্নীতি। এই দুর্নীতিকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য সমস্ত রাষ্ট্রযন্ত্রের কাঠামো দখল করা হয়েছিল। এটার জন্যই তো সংগ্রাম। সেই সংগ্রামে যেহেতু রাজনৈতিক দলগুলো শামিল, ফলে তাদের কাছ থেকে তো ইতিবাচক পরিবর্তন আশা করাই যায়, যদিও এটার লক্ষণ আমরা দেখিনি। ৫ আগস্ট থেকে দলবাজি, দখলবাজি একইভাবে হয়েছে। এখানে একটা ব্যানারের পরিবর্তন হয়েছে, চর্চাটা এখনো রয়ে গেছে। আমরা তো এটার জন্য আইন পরিবর্তন করতে বলেছি।

আমরা কর্তৃত্ববাদের সময়ও দেখেছি, অন্য সময়ও দেখেছি এবং অন্যান্য দেশেও যেটা হয়, সরকারি খাতে যে দুর্নীতি, সেটা এককভাবে সরকারি পর্যায় থেকে হয় না। সরকারি লোকজন, আমলাদের পাশাপাশি তৃতীয় পক্ষ হিসেবে আসে বেসরকারি মালিকানাধীন বা ব্যক্তি মালিকানাধীন খাত। সেখানে ঠিকাদার, প্রকল্প বাস্তবায়নকারী হিসেবে, সরবরাহকারী হিসেবে এতে তাদের ভূমিকা থাকে। এই অবস্থা থেকে যদি আমরা বের হতে চাই তাহলে বেসরকারি খাতের দুর্নীতিকেও বের করতে হবে। সেই লক্ষেই এই সুপারিশটা করা হয়েছে। ব্যক্তিমালিকানা খাতের দুর্নীতিকে অপরাধ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।

বিজ্ঞাপন

পরিবর্তনের সম্ভাবনা তৈরি করাও সম্ভব। আমাদের সুপারিশের মধ্যে অনেক কিছুই আছে, যা আশু করণীয়। সেগুলো আমরা চিহ্নিত করে সরকারের কাছে হস্তান্তর করেছি। এর মধ্যে আছে বেশ কিছু আইনি সংস্কার, নতুন কিছু আইনের দরকার, বেসরকারি খাতের দুর্নীতির বিষয়টি আছে, এর বাইরেও কিছু আইনি সংস্কারের দরকার আছে। বর্তমান সরকারের আমলেই অধ্যাদেশের মাধ্যমে এগুলো করা সম্ভব, যা পরবর্তীতে সংসদে অনুমোদিত হওয়ার চর্চা আছে।

দ্বিতীয়ত, ব্যবসা খাত, আমলাতন্ত্র ও রাজনীতি এই ত্রিপক্ষীয় আতাতের উপর ভিত্তি করে যে দুর্নীতি, সেটা নিয়ন্ত্রণের জন্য আমরা বেশ কিছু সুপারিশ করেছি। এগুলো দুদকে সরাসরি সক্ষমতা বৃদ্ধি করবে। এতে কাজেও গতি আসবে। দুদকের স্বাধীনতার পাশাপাশি জবাবদিহিতার ক্ষেত্রেও আমরা সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা দিয়েছি। দুদকের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি প্রতিরোধ করার জন্যও আমরা সুপারিশ করেছি। এগুলো এখনই করা সম্ভব। কাঠামোটাকে তৈরি করে যদি ধরে রাখা হয় তাহলে নির্বাচন পরবর্তীতে কার্যকরভাবে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

তদন্তের আগে অনুসন্ধান বন্ধ করতে সুপারিশ করা হয়েছে। কিন্তু অনুসন্ধান করা না হলে কিভাবে জানা যাবে একজন মানুষ কি পরিমাণ দুর্নীতি করেছেন। এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমরা তদন্ত না করতে বলিনি। আমরা বলেছি, তদন্তের আগে অনুসন্ধান করা বাধ্যতামূলক করা আছে। সেটা বন্ধ করতে বলেছি। ক্রিমিনাল অপরাধের ক্ষেত্রে কিন্তু অনুসন্ধান পর্যায়ে থাকে না। এটি উদ্দেশ্যমূলকভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

প্রথমত, এটা করা হয়েছে, দীর্ঘসূত্রতার জন্য। দ্বিতীয়ত, এটার জন্য যে সময় নেওয়া হয়, তাতে যার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান হচ্ছে, তিনি যদি প্রভাবশালী হন, তাহলে তিনি তথ্য সরিয়ে ফেলা থেকে শুরু করে বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ পান। আমরা এটা বন্ধ করতে বলেছি। পাশাপাশি এটার কারণে দুদকের কর্মকর্তাদের মধ্যেও অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। এই কারণে আমরা আন্তর্জাতিক চর্চাটা এখানে করতে বলেছি।

উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতি বন্ধে যে টাস্ক ফোর্স গঠনের প্রসঙ্গে বলেন, বিদেশে টাকা পাচারের ক্ষেত্রে দুই ধরনের টাস্কফোর্সের কথা বলা হয়েছে। সার্বিকভাবে বিভিন্ন দেশের চর্চা অনুযায়ী, দুদকের পাশাপাশি এনবিআর, বিএফআইইউ, অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস, সিআইডিকে আমরা যুক্ত করতে বলেছি। দুদকের একার পক্ষের সবসময় আইনগতভাবেই এসবের অনুসন্ধান করা সম্ভব হয় না। সবাই মিলে সমন্বিতভাবে কাজটা করলে প্রক্রিয়াটা সহজ হয়। টাস্কফোর্স সমন্বয়টা নিশ্চিত করবে বলে জানান সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান।

অপর একটি প্রসঙ্গে বলেন, যেহেতু উচ্চ পর্যায়ে অংশগ্রহণ বা নির্দেশে দুর্নীতিগুলো হয়, সেটা বন্ধ করার জন্য সাংবিধানিক অঙ্গীকারের কথা আমরা বলেছি। সংবিধানে এটাকে অন্তর্ভুক্ত করা বাধ্যতামূলক বলে আমরা মনে করি। আমাদের বর্তমান সংবিধানেও এটা বলা আছে। আমরা এর সঙ্গে একটু যুক্ত করতে বলেছি।

বর্তমান সরকারের সময় সংস্কারের যে উদ্যোগটা নেওয়া হয়েছে, এটা কিন্তু শুধু অন্তর্বর্তী সরকারের এজেন্ডা না। এটা কিন্তু জনগণের প্রত্যাশার জায়গা। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের মূল চেতনার জায়গা হলো, বাংলাদেশে দুর্নীতির যে গভীর বিস্তৃতি রয়েছে, সেটা দেশবাসী আর দেখতে চায় না। এটা যেহেতু সুনির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক এবং আমরা মনে করি, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে বলে নিঃসন্দেহে ধরে নেওয়া যায়। তাই এটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব, কিন্তু চ্যালেঞ্জ থাকবে বলে মনে করেন ড. ইফতেখারুজ্জামান।

শেয়ার দিয়ে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন...