ডিসেম্বর ২৪, ২০২৪

সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদসহ তার পরিবারের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে বিপুল সম্পদ গড়ে তোলার অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাছে আবেদন করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন।

‘অবৈধ সম্পদের পাহাড়’ গড়ার সংবাদ নিয়ে বেনজীর নীরবতা ভাঙার একদিন পর রবিবার দুদক চেয়ারম্যান বরাবর এ আবেদন করেন হবিগঞ্জ-৪ (চুনারুঘাট ও মাধবপুর) আসনের এই সংসদ সদস্য।

শনিবার নিজের ভেরিফায়েড ফেইসবুক পাতায় ‘আমার কিছু কথা’ শিরোনামে এক ভিডিও বার্তা নিয়ে হাজির হন বেনজীর। সেখানে তিনি তার বিরুদ্ধে সম্প্রতি কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের জবাব দেন। তিনি তার বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। একইসঙ্গে বলেন, তার সম্পদ অবৈধ বলে কেউ প্রমাণ করতে পারলে তা দান করে দেবেন তিনি।

গোপালগঞ্জের সন্তান বেনজীর দুই বছর আইজিপির দায়িত্ব পালনের পর ২০২২ সালে অবসর নেন। আইজিপির দায়িত্ব পালনের আগে তিনি র‌্যাবের মহাপরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন। তারও আগে তিনি ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার ছিলেন।

গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার তালিকায় র‌্যাবের যে সাতজন সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তার নাম আসে, তার মধ্যে বেনজীরও ছিলেন।

সম্প্রতি বেনজীরের নামটি আবার আলোচনায় উঠে আসে বসুন্ধরা গ্রুপের সংবাদপত্রগুলোতে একযোগে প্রতিবেদন প্রকাশের পর।

গত ৩১ মার্চ কালের কণ্ঠে প্রকাশিত হয় বিশেষ প্রতিবেদন ‘বেনজীরের ঘরে আলাদীনের চেরাগ’। কয়েকটি প্রতিবেদনে বিভিন্ন স্থানে ‘অবৈধ সম্পদের’ বিবরণ তুলে ধরা হয়। গোপালগঞ্জে তার রিসোর্টের কথাও বলা হয়। গাজীপুরে বনভূমি দখলের অভিযোগও করা হয়। তার চাকরি জীবনের আয়ের সঙ্গে এই সম্পদের মালিক হওয়া অসঙ্গতিপূর্ণ বলেও দাবি করা হয়।

বসুন্ধরা গ্রুপের আরও দুটি সংবাদমাধ্যম বাংলাদেশ প্রতিদিন ও বাংলানিউজেও একই শিরোনামে প্রতিবেদনগুলো প্রকাশিত হয়।

ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন দুদকে করা আবেদনে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী জিশান মির্জা, বড় কন্যা ফারহীন রিসতা বিনতে বেনজীর ও ছোট কন্যা তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীরের নামে বিপুল অবৈধ সম্পদ অর্জনের যে অভিযোগ উঠেছে, তার অনুসন্ধান প্রার্থনা করেন।

এ বিষয়ে সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন বলেন, “বেনজীরের বিরুদ্ধে যে রিপোর্ট আসছে- প্রায় হাজার কোটি টাকার, তার দুর্নীতির ব্যাপারে যে অভিযোগ আসছে পত্রিকায়, হেডলাইন হয়েছে। এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোনও ইনকোয়্যারির (অনুসন্ধান) ব্যবস্থা না দেখে, একজন নাগরিক হিসেবে দুদকে আবেদন করেছি।

“আবেদনে বলেছি, এটার (অভিযোগের) ইনকোয়্যারি (অনুসন্ধান) করা দরকার। কারণ, সাবেক আইজিপি মহোদয় যদি এত সম্পদ করে থাকে, তবে বাংলাদেশের পুলিশ ফোর্সের মধ্যে যারা সৎ অফিসার আছেন, তারা খুব বেশি ফ্রাসট্রেটেড (হতাশ) হয়ে পড়বেন। এবং দেশে যারা সৎ আছেন, তাদের ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়বে। আর যারা অসৎ আছেন, তারা মোটামুটি এই অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নামবেন। যদি অভিযোগ সত্য হয়ে থাকে, তাহলে তারা বলবেন- আমরা সবাই বেনজীর হইতে চাই। আমার কাছে মনে হয়েছে, দেশের জন্য এটা একটা ভয়ানক বিষয়!”

আবেদনের বিষয়ে দুদক কোনও পদক্ষেপ না নিলে হাইকোর্টে যাবেন বলেও জানান তিনি।

এ বিষয়ে দুদকের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খুরশীদ আলম খান সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা জানতে পেরেছি প্রাক্তন আইজিপি বেনজীর আহমেদের সম্পদ নিয়ে যে খবর ছাপা হয়েছে তার উপর ভিত্তি করে ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন দুদকে একটি দরখাস্ত দাখিল করেছেন। তার এই দরখাস্তের প্রেক্ষিতে দুদক তার আইন ও বিধি অনুসারে যাচাই-বাছাই করবে, কমিশন যদি মনে করে- এটি দুদকের আওতার মধ্যে পড়ে তাহলে দুদক আইন অনুসারে ব্যবস্থা নেবে।”

তিনি বলেন, “এখানে ব্যক্তি মুখ্য নয়। কে কী সেটি এখানে ইস্যু নয়। দুদক দেখে যে অভিযোগটি আসবে সেটি তফসিলভুক্ত অপরাধের মধ্যে পড়ে কিনা। কমিশন দেখবে, যে ডাটা দিয়েছে, তার সত্যতা কতটুকু। এখানে অনেকগুলো ধাপ আছে। উনি আজকে যে দরখাস্ত দিয়েছেন, তা যাচাই বাছাই কমিটিতে যাবে; কমিটি সেটা দেখবে, দেখার পরে তারা একটা সিদ্ধান্ত দেবেন। এরপর কমিশন কমিটির সিদ্ধান্তের আলোকে যদি মনে করে এটা অনুসন্ধান করা উচিত, তারা সেটি করবে।”

দুদকে করা আবেদন বলা হয়েছে, বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ ৩৪ বছর ৭ মাস চাকরি করে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর অবসরে যান। অবসর গ্রহণের পর দেখা যায়, বেনজীর আহমেদ তার স্ত্রী ও কন্যাদের নামে বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি অর্জন করেছেন, যা তার আয়ের তুলনায় অসম।

বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ‘অবৈধ সম্পদের পাহাড়’ গড়ার খবর প্রকাশের কয়েক সপ্তাহ পর শুক্রবার রাতে বেনজীর ঘোষণা দেন শনিবার বেলা সাড়ে ১১টায় তিনি লাইভে আসছেন। তখনই ধারণা করা যাচ্ছিল, সমালোচনার জবাব দিতেই তিনি আসছেন।

আধাঘণ্টার লাইভে বেনজীর বলেন, চাকরিকালীন সময় গত ২০১২ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিনি সোশাল মিডিয়ায় একটি গোষ্ঠী কর্তৃক অবিরত এবং ক্রমাগত ‘অপপ্রচার এবং ব্যক্তিগত চরিত্রহননের অপচেষ্টার’ শিকার হয়েছিলেন। অবসরকালে তিনি যখন নিরিবিলি জীবন কাটাচ্ছিলেন, তখন আবার একই রকম ‘অপপ্রচারের’ শিকার হলেন।

বেনজীর দাবি করেন, তার ও তার পরিবারের যে সম্পত্তি আছে, তার প্রতিটির বিপরীতে অর্থের উৎসসহ সংশ্লিষ্ট ট্যাক্স ফাইলে যথাযথভাবে উল্লেখ করা আছে। তিনি ও তার পরিবার নিয়মিতভাবে কর পরিশোধ করে সেরা করদাতার সম্মাননাও পেয়েছেন।

ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা থেকে প্রকাশিত সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে ‘প্রকৃত সত্য এবং তথ্য’ তুলে ধরার একটি নৈতিক তাগিদ থেকে শনিবার লাইভে আসা বলে জানান সরকারি চাকরিতে শীর্ষ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা এই কর্মকর্তা।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে হবিগঞ্জ-৪ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ব্যারিস্টার সুমন আওয়ামী লীগের প্রার্থী তখনকার বেসামরিক বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলীকে বড় ব্যবধানে হারান।

সোশাল মিডিয়ার আলোচিত মুখ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সুমন ছিলেন যুবলীগের কেন্দ্রীয় আইন বিষয়ক সম্পাদক। আওয়ামী লীগের এ সহযোগী সংগঠন থেকে ২০২১ সালে বহিষ্কার করা হয় তাকে। তবে নিজেকে আওয়ামী লীগের একজন কর্মী বলেই বলে আসছেন ব্যারিস্টার সুমন।

শেয়ার দিয়ে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন...