২০০০ সাল থেকে বর্তমান ২০২৩ সালের জুলাই পর্যন্ত দেশে এবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। চলতি বছরের জুন মাসের তুলনায় জুলাইয়ে দেশে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা সাতগুণ বেড়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
এ অবস্থায় ডেঙ্গু সংক্রমণের ক্রমবর্ধমান হার টেনে ধরতে সব সিটি করপোরেশন এলাকায় মশা নিধন কার্যক্রম আরও জোরদার করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সাধারণ মানুষকে ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতনভাবে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছে অধিদপ্তর।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, সারাদেশে ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়া ডেঙ্গুর সংক্রমণ মোকাবিলায় এডিস মশাবাহিত এ ভাইরাস প্রতিরোধী টিকাদান কার্যক্রম শুরুর বিষয়টি সরকারের বিবেচনায় আছে। তবে সরকার এ বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।
দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (এমআইএস) অধ্যাপক ডা. মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, দেশে জুন মাসে মোট ডেঙ্গু রোগী ছিল ৫ হাজার ৫৬ জন, সে তুলনায় ৩০ জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে ৩৮ হাজার ৪২৯ জন। অর্থাৎ জুনের তুলনায় জুলাই মাসে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ৭ গুণেরও বেশি বেড়েছে।
ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, এ বছরের ৩০ জুলাই পর্যন্ত মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর মধ্যে শতকরা বিবেচনায় পুরুষ রোগী ৬৪ শতাংশ, নারী ৩৬ শতাংশ। মধ্যবয়সী যারা, বিশেষত ১১ থেকে ৫০ বছর বসয়ীদের মধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে জনসচেতনতা তৈরির জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বলেও জানান তিনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২৩ বছরে দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা হচ্ছে- ২০০০ সালে আক্রান্ত ৫ হাজার ৫৫১ জন ও মৃত্যু ৯৩ জন, ২০০১ সালে আক্রান্ত ২ হাজার ৪৩০ ও মৃত্যু ৪৪, ২০০২ সালে আক্রান্ত ৬ হাজার ২৩২ ও মৃত্যু ৫৮, ২০০৩ সালে আক্রান্ত ৪৮৬ ও মৃত্যু ১০, ২০০৫ সালে আক্রান্ত ১ হাজার ৪৮ ও মৃত্যু ৪, ২০০৬ সালে আক্রান্ত ২ হাজার ২০০ ও মৃত্যু ১১, ২০০৭ সালে আক্রান্ত ৪০৬ ও মৃত্যু নেই, ২০০৮ সালে আক্রান্ত ২ হাজার ১৫৩ ও মৃত্যু নেই, ২০০৯ সালে আক্রান্ত ৪০৪ ও মৃত্যু নেই, ২০১০ সালে আক্রান্ত ৪০৯ ও মৃত্যু নেই, ২০১১ সালে আক্রান্ত ১ হাজার ৩৫৯ ও মৃত্যু ৬, ২০১২ সালে আক্রান্ত ৬৭১ ও মৃত্যু ১, ২০১৩ সালে আক্রান্ত ১ হাজার ৭৪৯ ও মৃত্যু ২, ২০১৪ সালে আক্রান্ত ৩৭৫ ও মৃত্যু নেই, ২০১৫ সালে আক্রান্ত ৩ হাজার ১৬২ ও মৃত্যু ৬, ২০১৬ সালে আক্রান্ত ৬ হাজার ৬০ ও মৃত্যু ১৪, ২০১৭ সালে আক্রান্ত ২ হাজার ৭৬৫ ও মৃত্যু ৮, ২০১৮ সালে আক্রান্ত ১০ হাজার ১৪৮ ও মৃত্যু ২৬, ২০১৯ সালে আক্রান্ত ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ ও মৃত্যু ১৭৯, ২০২০ সালে আক্রান্ত ১ হাজার ৪০৫ ও মৃত্যু ১০৫, ২০২১ সালে আক্রান্ত ২৮ হাজার ৪২৯ ও মৃত্যু ১০৫, ২০২২ সালে আক্রান্ত ৬২ হাজার ৩৮২ জন ও মৃত্যু ১৮১ জন।
চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুলাই পর্যন্ত সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ৪৯ হাজার ১৩৮ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ২৮ হাজার ৩২। ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হয়েছেন ২১ হাজার ১০৬। একই সময়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন ৩৯ হাজার ৪৭৩। যার মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ২২ হাজার ৬৯৩ এবং ঢাকার বাইরের ১৬ হাজার ৭৮০ জন। চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৩০ জুলাই পর্যন্ত মারা গেছেন ২৪৭ জন।
ডেঙ্গু মোকাবিলায় বিশেষজ্ঞ পরামর্শ:
দেশে চলতি বছরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে ওঠার জন্য প্রশাসনিক ব্যর্থতাকেই দায়ী করছেন আইইডিসিআর’বির উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন।
তিনি বলেন, স্বাস্থ্য প্রশাসন ও নগর কর্তৃপক্ষ ডেঙ্গু পরিস্থিতিকে ‘গা ছাড়া’ ভাবে দেখেছে বলেই বর্তমানে এ অবস্থা। সরকারের উচিৎ, ডেঙ্গু পরিস্থিতিকে জনস্বাস্থ্যের জন্য জরুরি অবস্থা হিসাবে ঘোষণা দেওয়া। পাশাপাশি এটাকে মহামারির মতো পরিস্থিতি হিসাবে মোকাবিলা করা। পরিকল্পিত উপায়ে লড়াই করলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। ডেঙ্গু প্রতিরোধে এখন যে কাজ হচ্ছে সেটা রুটিন কাজ।
প্রত্যেক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডেঙ্গু রোগীকে শনাক্ত করে তিন পর্যায়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করার পরামর্শ দিয়েছেন এই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং জরুরি রোগীদের জন্য মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। আক্রান্ত সবাইকে চিকিৎসার মধ্যে রাখলে রোগ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি গুরুতর রোগীও কমে যাবে বলে মনে করেন তিনি।
মশা নিধন কার্যক্রম নিয়ে ড. মুশতাক বলেন, ওয়ার্ড পর্যায়ে যে কমিটি করার কথা বলা হয়েছিল সেটি বাস্তবায়ন করতে হবে। কমিটির ভলান্টিয়াররা প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নেবে, ডেঙ্গু রোগী আছে কি না? তারা স্থানীয়দের নিয়ে মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করবে। রোগী পাওয়া গেলে তাকে হাসপাতালে পাঠাবে।