সেপ্টেম্বর ৮, ২০২৪

কঠোর মুদ্রানীতি প্রয়োগের মাধ্যম বাজারে টাকার প্রবাহ কমিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক। যদিও দীর্ঘ সময় ধরে এ কৌশল ভাল ফলাফল অর্জন করতে পারেনি। তবুও আরও কঠোর নীতি প্রয়োগ করতে চাচ্ছেন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।

মঙ্গলবার (১৬ জু্লাই) চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতি বাংলাদেশ ব্যাংকের বোর্ডে পাশ হয়েছে।

তথ্য অনুযায়ী, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সর্বাধিক অগ্রাধিকার দিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধের জন্য আবারও সংকোচনমুখী মুদ্রানীতির ঘোষণা দিতে যাচ্ছেন গভর্নর। ২০২২ সালের জুলাই মাসে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে একই নীতি প্রয়োগ করে আসছেন তিনি। তিন মাসের মধ্যে ফলাফল ঘরে তোলার ঘোষণা দিয়ে দুই বছরের তা অর্জন করতে পারেননি। চড়া মূল্যস্ফীতি অব্যাহত থাকার প্রেক্ষাপটে প্রবৃদ্ধিতে ছাড় দিয়ে টাকার প্রবাহ আরও কমানোর ঘোষণা আসছে এবারের মুদ্রানীতিতে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও ভারপ্রাপ্ত মুখপাত্র সাইফুল ইসলাম বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল লক্ষ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। এরই ধারাবাহিকতায় এবারও সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করা হবে। যদিও শুধু মুদ্রানীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানা সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে অন্যান্য সূচকগুলোও কাজে লাগাতে হবে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, আগামী মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে টাকাকে আকর্ষনীয় করতে হবে। সেটা ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। সেইসাথে নীতি সুদহার আরও বাড়াতে হবে। সেটা বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করলে ভালো হয়। দ্বিতীয়ত, ব্যাংকগুলোকে যে তারল্য সহায়তা দেওয়া হচ্ছে, সেটি বন্ধ করতে হবে। তৃতীয়ত, এখন প্রবাসী আয়ে যে প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে, তাও বন্ধ করে দিতে হবে। সেখানে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা সরকারের বেঁচে যাবে, যা শিক্ষা বা স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করতে পারবে।

তিনি আরও বলেন, কারণ ডলারের দাম বাজারভিত্তিক হয়ে গেছে। এসব প্রণোদনা খাচ্ছে দুবাইয়ের কিছু প্রতিষ্ঠান, যার সঙ্গে যুক্ত স্বার্থান্বেষী মহল। এটা প্রকৃত রেমিটারদের কোন উপকারে আসছে না। এই উদ্যোগগুলো নিলেই মূল্যস্ফীতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।

গত মে মাসে সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। পাশাপাশি ডলারে এক লাফে ৭ টাকা বাড়িয়ে ১১৭ টাকা মধ্যবর্তী দর ঠিক করা হয়েছে। একইসঙ্গে বাড়ানো হয় নীতি সুদহারও। এরপরও মূল্যস্ফীতি অপরবির্তিত থাকায় নীতি সুদহার আরও বাড়ানো হচ্ছে বলে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে এখন প্রধান অগ্রাধিকার দিয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে কমলেও বাংলাদেশে এখনও উচ্চ মূল্যস্ফীতিই রয়েছে। এর অন্যতম কারণ অন্য দেশের তুলনায় অনেক দেরিতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অনেক দেরিতে এসে ডলারের দর ও সুদহার বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশে শুধু মুদ্রা সরবরাহের কারণেই মূল্যস্ফীতি বাড়ে-কমে তেমনটি নয়। এখানে বাজার ব্যবস্থাপনাসহ অনেক বিষয় জড়িত। ফলে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির পাশাপাশি অবশ্যই বাজার তদারকি জোরদার করতে হবে।

২০২৩-২৪ অর্থবছর বাজেটের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৭ শতাংশে রাখার ঘোষণা দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে গত জুন শেষে গড় মূল্যস্ফীতি ঠেকেছে ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশে। চলতি অর্থবছর মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে সীমিত রাখার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। আর এ জন্য ডলার বিক্রির মাধ্যমে বাজার থেকে টাকা উত্তোলনের পাশাপাশি সরকারকে টাকা ছাপিয়ে ধার দেওয়া বন্ধ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অবশ্য সংকটে থাকা কয়েকটি ব্যাংককে নানা উপায়ে ধার দেওয়ায় মুদ্রা সরবরাহ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নিয়ন্ত্রণে থাকছে না।

সংশ্লিষ্টরা জানান, করোনার কারণে অর্থনীতিতে স্থবিরতার পর ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে চাহিদা বাড়তে শুরু করে। এর পরই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য অনেক বেড়ে যায়। ওই সময়ে চাহিদা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি ঠেকাতে বেশির ভাগ দেশ সুদহার বাড়িয়ে দেয়। তবে বাংলাদেশে গত জুন পর্যন্ত গ্রাহক পর্যায়ে ৯ শতাংশ সুদহারের সীমা অপরিবর্তিত ছিল। আবার ২০২২-২৩ অর্থবছরে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে প্রায় ৯৮ হাজার কোটি টাকা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া কৃত্রিমভাবে ডলারের দর ধরে রাখার চেষ্টা অব্যাহত ছিল। তবে সব চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় গত ৮ মে সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। একই দিন নীতি সুদহার আরও ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে রেপোতে সাড়ে ৮ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। আর গত অর্থবছর বাংলাদেশ ব্যাংকে সরকারের ঋণ কমানো হয়েছে ৬ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকা।

সাধারণত সংবাদ সম্মেলন করে গভর্নর ও বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আনুষ্ঠানিকভাবে মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন। সেখানে বিভিন্ন প্রশ্ন করার সুযোগ পান সাংবাদিকরা। জানা গেছে, এই প্রথা ভেঙে আগামী ১৮ তারিখ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েবসাইটে মুদ্রানীতি প্রকাশ করা হতে পারে। দুটি কারণে এরকম করা হতে পারে। প্রথমত, বিভিন্ন অনিয়ম ও আর্থিক খাতের দুরবস্থা নিয়ে গণমাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশের পর গত মার্চ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয়ত, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছাগলকাণ্ডে আলোচিত এনবিআরের সাবেক কর্মকর্তা মতিউর রহমানের সঙ্গে গভর্নরের ছবি দেখার পর তিনি সাংবাদিকদের মুখোমুখি হতে চাচ্ছেন না।

শেয়ার দিয়ে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *