টানা পাঁচ মাসের বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনের গাজায় আকাশ ও স্থলপথে হামলা করে চলেছে ইসরায়েল। এতে করে ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ ওই ভূখণ্ডটিতে তীব্র মানবিক সংকট দেখা দিয়েছে।
গাজার ফিলিস্তিনিরা ‘দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে’ রয়েছে বলে সম্প্রতি মন্তব্য করেছে জাতিসংঘের একটি সংস্থা। এমন অবস্থায় গাজার বিপর্যয়কর খাদ্য ঘাটতির মানে আরও ব্যাপক সংখ্যক মানুষের মৃত্যু আসন্ন।
এমনকি দুর্ভিক্ষ-অনাহারে মৃত্যুর ঝুঁকিতে পড়তে পারেন ৩ লাখ ফিলিস্তিনি। এই অবস্থায় জরুরি ভিত্তিতে ভূখণ্ডটিতে যুদ্ধবিরতি ও ত্রাণসহায়তা নিশ্চিত করতে হবে বলে জানিয়েছে বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টিগ্রেটেড ফুড-সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন (আইপিসি)।
জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এমনটাই জানিয়েছে তারা। মঙ্গলবার (১৯ মার্চ) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা রয়টার্স।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজা উপত্যকার কিছু অংশে চরম খাদ্য ঘাটতি ইতোমধ্যেই দুর্ভিক্ষের মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে এবং তাৎক্ষণিকভাবে যুদ্ধবিরতি এবং যুদ্ধের কারণে বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে খাদ্য সরবরাহ করা না হলে সেখানে ব্যাপক সংখ্যক মানুষের মৃত্যু আসন্ন বলে আইপিসি সোমবার জানিয়েছে।
জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার তথ্যের ওপর নির্ভর করে প্রস্তুত করা নিজেদের মূল্যায়নে ইন্টিগ্রেটেড ফুড-সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন (আইপিসি) বলেছে, গাজার উত্তরাঞ্চলের কিছু অংশের ৭০ শতাংশ মানুষ সবচেয়ে মারাত্মক স্তরের খাদ্য ঘাটতিতে ভুগছে। মূলত কোনও অঞ্চলে ২০ শতাংশ মানুষ এই মাত্রায় খাদ্যসংকটে থাকলে তাকে দুর্ভিক্ষ বলে বিবেচনা করা হয়। আর গাজার এই অঞ্চলে সেই অবস্থার ৩ গুণেরও বেশি মানুষ খাদ্য সংকটে রয়েছেন।
আইপিসি বলেছে, তাদের কাছে মৃত্যুর হারের পর্যাপ্ত তথ্য নেই। তবে সংস্থাটির অনুমান, দুর্ভিক্ষের কারণে যে হারে মানুষ মরতে শুরু করে, গাজায়ও সেই পরিস্থিতি শুরু হয়ে যাবে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে ক্ষুধা, অপুষ্টি আর বিভিন্ন রোগে সাধারণত প্রতি ১০ হাজার জনে দুজন মারা যায়।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, অপুষ্টিতে এ পর্যন্ত ২৭ জন শিশু ও তিনজন প্রাপ্তবয়স্কের মৃত্যু হয়েছে।
আইপিসি বলছে, ‘দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধে যেসব পদক্ষেপ প্রয়োজন, তার মধ্যে গাজার সমগ্র জনসংখ্যার জন্য মানবিক সহায়তার প্রবেশের পাশাপাশি ও বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড শুরুর করাটা উল্লেখযোগ্য এবং অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির জন্য একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও প্রয়োজন।’
সংস্থাটি বলছে, সব মিলিয়ে গাজার ১১ লাখ মানুষ খাদ্যের ‘বিপর্যয়কর’ ঘাটতিতে রয়েছে এবং ভূখণ্ডটির প্রায় ৩ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষের কারণে মৃত্যুর ঝুঁকিতে রয়েছেন।
মূলত গাজায় মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষের এই আশঙ্কার ফলে পশ্চিমা মিত্রদের কাছ থেকে কঠোর সমালোচনার মুখে পড়েছে ইসরায়েল। ইইউর পররাষ্ট্র নীতির প্রধান জোসেপ বোরেল ব্রাসেলসে এক কনফারেন্সে বলেছেন, ‘গাজায় আমরা এখন আর দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে নেই। আমরা দুর্ভিক্ষের ভেতরেই রয়েছি… অনাহারকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ইসরায়েল দুর্ভিক্ষকে উস্কে দিচ্ছে।’
ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছেন, বোরেলের উচিত ‘ইসরায়েলে আক্রমণ করা বন্ধ করা এবং হামাসের অপরাধের বিরুদ্ধে আমাদের আত্মরক্ষার অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া’।
এর আগে ইউএন রিলিফ অ্যান্ড ওয়ার্কস এজেন্সি ফর প্যালেস্টাইন রিফিউজিস (ইউএনআরডব্লিউএ) জানায়, উত্তর গাজায় দুই বছরের কম বয়সী প্রতি তিনজন শিশুর মধ্যে একজন শিশু এখন তীব্রভাবে অপুষ্টিতে ভুগছে।
সংস্থাটি সতর্ক করে আরও জানায়, পাঁচ মাসেরও বেশি সময় ধরে নিরলস ইসরায়েলি বোমা হামলার সম্মুখীন হওয়া অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ডে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে।
এদিকে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস আইপিসি রিপোর্টকে ‘ভয়ঙ্কর অভিযোগ’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ইসরায়েলকে অবশ্যই গাজার সমস্ত অংশে সম্পূর্ণ এবং নিরবচ্ছিন্নভাবে সহায়তা প্রবেশের অনুমতি দিতে হবে।
ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন বলেছেন, তিনি সতর্কতার সাথে প্রতিবেদনটি পর্যালোচনা করবেন। তিনি বলছেন, এটি স্পষ্ট সেখানে স্থিতাবস্থা টেকসই নয়। দুর্ভিক্ষ এড়াতে আমাদের এখনই জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।’
গাজায় ১৩ হাজারের বেশি শিশু নিহত, গুরুতর অপুষ্টিতে অন্যরা: ইউনিসেফ
উল্লেখ্য, গত ৭ অক্টোবর হামাসের নজিরবিহীন আন্তঃসীমান্ত হামলার পর থেকে ইসরায়েল গাজা উপত্যকায় অবিরাম বিমান ও স্থল হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। ইসরায়েলি এই হামলায় হাসপাতাল, স্কুল, শরণার্থী শিবির, মসজিদ, গির্জাসহ হাজার হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে।
ফিলিস্তিনের গাজা ভূখণ্ডের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গাজায় ইসরায়েলের আক্রমণের ফলে এখন পর্যন্ত ৩১ হাজার ৭০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। এছাড়া আহত হয়েছেন আরও প্রায় ৭৪ হাজার মানুষ।
এছাড়া ইসরায়েলি আগ্রাসনের কারণে প্রায় ২০ লাখেরও বেশি বাসিন্দা তাদের বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।