ইসরায়েলের বর্বরোচিত বিমান হামলায় বিপর্যস্ত ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা। স্থল পথেও সেনা অভিযান চলার কারণে ভূখণ্ডটিতে সৃষ্টি হয়েছে তীব্র মানবিক সংকট।
পরিস্থিতি এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে, গাজার মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই থাকছেন অনাহারে। জাতিসংঘ এই হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে। রোববার (১০ ডিসেম্বর) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজার অর্ধেক জনসংখ্যা অনাহারে রয়েছেন বলে জাতিসংঘের একজন ঊর্ধ্বতন ত্রাণ কর্মকর্তা সতর্ক করেছেন।
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) ডেপুটি ডিরেক্টর কার্ল স্কাউ বলেছেন, গাজায় যে পরিমাণ সহায়তা প্রয়োজন তার খুব কম অংশই সেখানে সরবরাহ করা সম্ভব হয়েছে এবং গাজার ১০ জনের মধ্যে ৯ জন মানুষই প্রতিদিন খেতে পারেন না।
স্কাউ বলেন, গাজার চলমান পরিস্থিতির কারণে সেখানে সহায়তা সরবরাহ ‘প্রায় অসম্ভব’ হয়ে উঠেছে।
অবশ্য ইসরায়েল বলছে, হামাসকে নির্মূল করতে এবং ইসরায়েলি বন্দিদের ফিরিয়ে আনতে গাজায় বিমান হামলা চালিয়ে যেতে হবে। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল রিচার্ড হেচট শনিবার বিবিসিকে বলেছেন, ‘কোনও বেসামরিক ব্যক্তির মৃত্যু এবং দুর্ভোগ আমাদের কাছে বেদনাদায়ক, তবে আমাদের কাছে আর কোনও বিকল্প নেই’।
তার দাবি, ‘গাজা ভূখণ্ডের ভেতরে যতটা সম্ভব অগ্রগতি অর্জন করতে আমরা সবকিছু করছি।’
উল্লেখ্য, গত ৭ অক্টোবর হামাসের নজিরবিহীন আন্তঃসীমান্ত হামলার পর থেকে ইসরায়েল গাজা উপত্যকায় অবিরাম বিমান ও স্থল হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। ইসরায়েলি এই হামলায় হাসপাতাল, স্কুল, শরণার্থী শিবির, মসজিদ, গির্জাসহ হাজার হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে।
মাঝে হামাসের সাথে এক সপ্তাহব্যাপী মানবিক বিরতির পর গত সপ্তাহ থেকে গাজা উপত্যকায় পুনরায় বিমান ও স্থল হামলা শুরু করে ইসরায়েল। বিরতির পর শুরু হওয়া এই অভিযানে গাজায় হামলা আরও তীব্র করেছে দখলদার সেনারা।
গাজার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েল গাজা উপত্যকায় ব্যাপক সামরিক অভিযান শুরু করার পর থেকে সেখানে কমপক্ষে ১৭ হাজার ৭০০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত এবং আরও ৪৬ হাজার মানুষ বেশি আহত হয়েছেন।
নিহত এসব ফিলিস্তিনিদের মধ্যে কমপক্ষে ৭ হাজার ১১২ জন শিশু এবং ৪ হাজার ৮৮৫ জন নারী রয়েছেন। এছাড়া ভূখণ্ডটিতে এখনও প্রায় ৭ হাজার ৬০০ জন নিখোঁজ রয়েছেন।
সংঘাত শুরুর পর শুধুমাত্র মিসরের সীমান্তবর্তী রাফাহ ক্রসিং উন্মুক্ত করা হয়েছে। এর ফলে সীমিত পরিমাণে সাহায্য গাজায় পৌঁছাতে পারছে। এই সপ্তাহে ইসরায়েল আগামী কয়েক দিনের মধ্যে ইসরায়েল থেকে গাজায় প্রবেশের কেরাম শালোম ক্রসিং খুলতে সম্মত হয়েছে। তবে তা শুধুমাত্র সাহায্য লরি পরিদর্শনের জন্য। এরপর ট্রাকগুলো রাফাহ হয়ে গাজায় প্রবেশ করবে।
স্কাউ বলছেন, চলতি সপ্তাহে গাজা সফরের সময় তিনি এবং তার ডব্লিউএফপি টিম যে ‘ভয়, বিশৃঙ্খলা এবং হতাশার’ সম্মুখীন হয়েছেন তার জন্য তারা প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি বলেন, গাজার গুদামগুলোতে বিভ্রান্তি, বিতরণ পয়েন্টগুলোতে হতাশায় নিমজ্জিত হাজার হাজার ক্ষুধার্ত মানুষের ভিড়, খালি তাকসহ সুপারমার্কেট এবং উপচে পড়া আশ্রয়কেন্দ্রগুলো প্রত্যক্ষ করেছেন তারা।
আন্তর্জাতিক চাপ এবং সাত দিনের সাময়িক যুদ্ধবিরতি গত মাসে গাজা উপত্যকায় কিছু অতি-প্রয়োজনীয় সাহায্য প্রবেশের সুযোগ দিয়েছে। কিন্তু ডব্লিউএফপি জোর দিয়ে বলছে, মানুষের চাহিদা মেটাতে এখন গাজার দ্বিতীয় সীমান্ত ক্রসিং উন্মুক্ত করা প্রয়োজন।
স্কাউ-এর মতে, কিছু এলাকায় ১০টির মধ্যে ৯টি পরিবার ‘কোনও খাবার ছাড়াই পুরো দিন এবং রাত কাটাচ্ছেন’।
গাজার দক্ষিণে অবস্থিত খান ইউনিস শহরের পরিস্থিতিও খুবই ভয়াবহ। শহরের একমাত্র অবশিষ্ট স্বাস্থ্য কেন্দ্র নাসের হাসপাতালের প্লাস্টিক সার্জারি এবং বার্ন ইউনিটের প্রধান ডা. আহমেদ মোগরাবি খাবারের অভাব নিয়ে বিবিসির সাথে কথা বলার সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন।
তিনি বলেন, ‘আমার তিন বছর বয়সী একটি মেয়ে আছে, সে সবসময় আমার কাছে কিছু মিষ্টি, কিছু আপেল, কিছু ফল চায়। আমি দিতে পারি না। আমি অসহায় বোধ করি। পর্যাপ্ত খাবার নেই, পর্যাপ্ত কোনও খাবারই নেই, শুধুমাত্র ভাত, শুধুমাত্র ভাত আছে- আপনি বিশ্বাস করতে পারেন? আমরা দিনে একবার, মাত্র একবার খাই।’