পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আরএন স্পিনিং মিলস ও ফার কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের কারসাজি বা প্রতারণা রোধ করে বিনিয়োগকারীদের পুঁজির সুরক্ষা দিতে পৃথক কোম্পানির সঙ্গে একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। একীভূকরণে আগে কোম্পানি দু’টি পুঁজিবাজার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার (ডিলিস্টিং) সুযোগ খুঁজছিল। তবে অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশনের বিচক্ষণ ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে কোম্পানি দুইটি হাই কোর্টের নির্দেশনায় একীভূতকরণ হতে বাধ্য হয়। এই একীভূতকরণ প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন না হলে বিনিয়োগকারীরা বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হতো বলে মনে করে কমিশন।
এই দুইটি কোম্পানি অপেক্ষাকৃত মৌলভিত্তি সম্পন্ন ও উৎপাদনের থাকা কোম্পানির সঙ্গে একীভূত হয়েছে। এর মধ্যে আরএন স্পিনিং মিলস লিমিটেডের সঙ্গে সামিন ফুড অ্যান্ড বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যান্ড টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড এবং ফার কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের সঙ্গে এস.এফ টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড একীভূত হয়েছে। এর ফলে কোম্পানি দুইটি আর্থিক সক্ষমতা বেড়েছে। কিন্তু কোম্পানি দুইটি যদি পুঁজিবাজার থেকে বেরিয়ে যেত বা ডিলিস্টিং হতো তাহলে বিনিয়োগকারীরা তাদের বিনিয়োগকৃত পুঁজি হারিয়ে সর্বশান্ত হতেন। বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা এবং স্বার্থ রক্ষার্থে একীভূতকরণের প্রক্রিয়া বেছে নিয়েছে বিএসইসি।
বর্তমানে পুঁজিবাজারে কোম্পানি দু’টির নিয়মিত লেনদেন হচ্ছে। এর ফলে কোম্পানি দুইটির শেয়ার কেনাবেচা করতে পারছেন বিনিয়োগকারীরা। একীভূতকরণের আগে বছরের পর বছর কোম্পানি দুইটির শেয়ারের কোনো ক্রেতা ছিল না। একীভূতকরণের ফলে ভবিষ্যতে কোম্পানি দুইটির আয় বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর আয় বাড়লে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দিতে সক্ষম হবে কোম্পানি দুইটি। আর এ কারণেই কোম্পানি দুইটিকে ডিলিস্টিং হতে দেয়নি বিএসইসি।
পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, বিগত কয়েক কমিশনের আমলে অনেক দূর্বল কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। সেসব কোম্পানির তালিকাভুক্তির মূল উদ্দেশ্য ছিল পুঁজিবাজার থেকে সংগ্রহীত টাকা দিয়ে ব্যবসা সম্প্রসারণ ও ঋণ পরিশোধ করে আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। কিন্তু কোম্পানিগুলো কয়েক বছর উৎপাদনে থাকলেও পরবর্তীতে বন্ধ হয়ে যায়। ওইসব কোম্পানির কারণে বর্তমান কমিশনকে বিব্রত হতে হচ্ছে।
দীর্ঘদিন অবহেলিত পুঁজিবাজার উন্নয়নে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে বিগত কয়েক কমিশনের ইস্যু করা মানহীন কোম্পানিগুলো। এতে একের পর এক পুঁজিবাজার উন্নয়নে নেওয়া পদক্ষেপের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান কমিশনের অর্জনগুলো বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এসব কোম্পানি বতর্মান কমিশনের জন্য বিষফোড়া হয়েছে দাঁড়িয়েছে। ওই মানহীন কোম্পানিগুলোকে সক্ষমতায় ফিরিয়ে আনতে বর্তমান কমিশনের সুনাম ও পন্ডশ্রম হচ্ছে।
একীভূতকরণ স্কিম অনুসারে, সামিন ফুডের সব সম্পদ ও দায় আরএন স্পিনিং মিলসের অনুকূলে হস্তান্তর করা হয়। এ দুই কোম্পানির বিদ্যমান সব ইকুইটি শেয়ার বাতিল করা হয়। আরএন স্পিনিংয়ের সঙ্গে ১: ০.১৭৯০ অনুপাতে সামিন ফুডের শেয়ার বিনিময় করা হয়েছে। আরএন স্পিনিংকে সামিন ফুডের শেয়ারধারীদের কোম্পানিটির ২৩ কোটি ৩১ লাখ ৮৬ হাজার ৫৮৪টি শেয়ারের বিপরীতে নিজেদের সমসংখ্যক শেয়ার ইস্যু করা হয়। এক্ষেত্রে সামিন ফুডের বিদ্যমান ১টি শেয়ারের বিনিময়ে আরএন স্পিনিং মিলসের ১টি নতুন শেয়ার ইস্যু করা হয়। তবে আরএন স্পিনিংয়ের বিদ্যমান বিনিয়োগকারীদের কাছে থাকা ৩৯ কোটি ২৫ লাখ ৪৪ হাজার ৮৩৪টি শেয়ারের বিনিময়ে নতুন করে কোম্পানিটির ৭ কোটি ২ লাখ ৬৫ হাজার ৫২৫টি শেয়ার ইস্যু করা হয়। এক্ষেত্রে একীভূতকরণের আগে থাকা আরএন স্পিনিং মিলসের বিদ্যমান ৫.৫৯টি শেয়ারের বিপরীতে একীভূতকরণের পরে নতুন করে কোম্পানিটির ১টি শেয়ার ইস্যু করা হয়।
এদিকে এসএফ টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজের সব সম্পদ ও দায় ফার কেমিক্যালের অনুকূলে হস্তান্তর করা হয়। এ দুই কোম্পানি বিদ্যমান সব ইকুইটি শেয়ার বাতিল করা হয়। ফার কেমিক্যালের সঙ্গে ৩:১.৯৬১৪ অনুপাতে এসএফ টেক্সটাইলের শেয়ার বিনিময় করা হয়েছে। ফার কেমিক্যালকে এসএফ টেক্সটাইলের শেয়ারধারীদের কোম্পানিটির ১৫ কোটি ৭৬ লাখ ৯৫ হাজার ৬৩০টি শেয়ারের বিপরীতে নিজেদের ৮ কোটি ৩ লাখ ৯৯ হাজার ৫২৫টি শেয়ার ইস্যু করা হয়। এক্ষেত্রে এসএফ টেক্সটাইলের বিদ্যমান ১.৯৬১৪টি শেয়ারের বিনিময়ে ফার কেমিক্যালের ১টি নতুন শেয়ার ইস্যু করা হয়। ফার কেমিক্যালের বিদ্যমান বিনিয়োগকারীদের কাছে থাকা ২১ কোটি ৮০ লাখ ৯৩ হাজার ৪২৩টি শেয়ারের বিনিময়ে নতুন করে কোম্পানিটির ৭ কোটি ২৬ লাখ ৯৭ হাজার ৮০৮টি শেয়ার ইস্যু করে। এক্ষেত্রে একীভূতকরণের আগে থাকা ফার কেমিক্যালের বিদ্যমান ৩টি শেয়ারের বিপরীতে একীভূতকরণের পরে নতুন করে ১টি শেয়ার ইস্যু করা হয়।
প্রসঙ্গত, ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে কোম্পানি দুটির পরিচালনা পর্ষদ একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত নেয়। নিয়ম মতে, একীভূতকরণ স্কিমের অনুমতি চেয়ে হাইকোর্টের কাছে আবেদন করা হয়। আর ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে হাইকোর্ট কোম্পানি দুটির আবেদন অনুমোদন করে চূড়ান্ত রায় দেন। ওই রায়ে একীভূতকরণের বেশ কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়। হাইকোর্টের সম্মতির পাওয়ার পর এই বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমতি চেয়ে আবেদন করা হলে সম্প্রতি তাদেরকে অনুমতি দেয় বিএসইসি।