নভেম্বর ১৫, ২০২৪

করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবায় জরুরিভিত্তিতে হাসপাতালগুলোতে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, মেডিকেল টেকনিশিয়ান ও ক্যার্ডিওগ্রাফারসহ প্রায় দুই হাজার ৮০০ শূন্য পদে জনবল নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। ওই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় নানা ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে।

প্রতিটি নিয়োগে ১৫-২০ লাখ টাকার অবৈধ লেনদেন, এমনকি উত্তরপত্রে একাধিক স্ট্যাপলিং করা ছিদ্র এবং পেন্সিলে লেখা অস্পষ্ট সংকেত পাওয়ার প্রমাণ মিলেছে। দুর্নীতি ও অনিয়মের পুরো এ প্রক্রিয়ার মুখোশ উন্মোচনে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

জানা যায়, ২০২০ সালের ওই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির বিপরীতে ৭২ হাজারের বেশি আবেদন জমা হয়। ওই বছরের ডিসেম্বরে লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে টেকনিশিয়ান ও টেকনোলজিস্ট পদে উত্তীর্ণ হন চার হাজার ৪৫৩ জন। মৌখিক পরীক্ষা শেষে চূড়ান্ত উত্তীর্ণদের নিয়োগ দেওয়া কথা।

দুর্নীতির গন্ধ আরও গাঢ় হয় যখন ওইসব পরীক্ষার্থী লিখিত পরীক্ষায় ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ নম্বর পেলেও মৌখিক পরীক্ষায় ফেল করেন বা অনেক কম নম্বর পান। এমনকি খাতায় লেখা প্রশ্নের বিষয়ে যথাযথ জবাবও দিতে ব্যর্থ হন তারা। অথচ কম নম্বর পাওয়া পরীক্ষার্থীরা মৌখিক পরীক্ষায় অনেক ভালো করেন

বিষয়টি স্বাভাবিক মনে হলেও সন্দেহের সূত্রপাত হয় তখন যখন দেখা যায় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ৮০ থেকে ৮৫ ভাগ পরীক্ষার্থী অস্বাভাবিক বেশি নম্বর পান। দুর্নীতির গন্ধ আরও গাঢ় হয় যখন ওইসব পরীক্ষার্থী লিখিত পরীক্ষায় ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ নম্বর পেলেও মৌখিক পরীক্ষায় ফেল করেন বা অনেক কম নম্বর পান। এমনকি খাতায় লেখা প্রশ্নের বিষয়ে যথাযথ জবাবও দিতে ব্যর্থ হন তারা। অথচ কম নম্বর পাওয়া পরীক্ষার্থীরা মৌখিক পরীক্ষায় অনেক ভালো করেন।

এরপরই বিভিন্ন মাধ্যম থেকে ঘুষ লেনদেনের তথ্য প্রকাশ পেতে থাকে। পদপ্রতি ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে বলে জানা যায়। যাদের পাস করাতে লিখিত পরীক্ষার উত্তরপত্র পরিবর্তন করা হয়। সন্দেহভাজন পরীক্ষার্থীদের প্রতিটি খাতায় নানা ধরনের সাংকেতিক চিহ্ন, এমনকি হাতের লেখায়ও অমিল পাওয়া যায়। নানা বিতর্কে নিয়োগ প্রক্রিয়া প্রথমে স্থগিত এবং পরে বাতিল করা হয়। এরপর ঘুষ লেনদেনের ওই সিন্ডিকেটের মুখোশ উন্মোচনে মাঠে নামে দুদক।

দুদকের অনুসন্ধানে প্রায় ২৫০০ পরীক্ষার্থীর উত্তরপত্রে একাধিক স্ট্যাপলিং করা ছিদ্র এবং পেন্সিলে লেখা বিভিন্ন ধরনের সংকেতের প্রমাণ মেলে। যার সঠিক ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ হন পরীক্ষার দায়িত্বে থাকা নিয়োগ কমিটির কর্মকর্তারা। যে কারণে সংস্থাটি অনুসন্ধানে নামে। অনুসন্ধানে নিয়োগ কমিটির সভাপতি ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) মো. হাসান ইমাম, সদস্য সচিব ও উপপরিচালক আ খ ম আখতার হোসেন, খিলগাঁও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র সহকারী শিক্ষক মো. হারুনুর রশিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিত বিভাগের চেয়ারম্যান মো. শাওকত আলীর সরাসরি সম্পৃক্ততার প্রমাণ মেলে। শুধু তা-ই নয়, অবৈধ নিয়োগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত যাদের নাম আসে তাদের বিষয়েও চমকে যাওয়ার মতো তথ্য-উপাত্ত মেলে বলে জানায় সংশ্লিষ্ট সূত্র।

দুদকের অনুসন্ধানে যা পাওয়া যায়

লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ চার হাজার ৪৫৩টি খাতা, টেবুলেশন শিট ও অন্যান্য উপকরণ পরীক্ষার পর দুই হাজার ৪১১টি উত্তরপত্রে একাধিক স্ট্যাপলিং করা ছিদ্র এবং পেন্সিলে লেখা বিভিন্ন ধরনের সংকেতের প্রমাণ পান দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা। এসব বিষয়ে চাকরিপ্রার্থীদের জিজ্ঞাসাবাদে তারা কোনো সঠিক তথ্য দুদককে দিতে পারেননি। তবে, জানা যায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে কর্মরত বিভিন্ন অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীর যোগসাজশে চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে ক্ষেত্রবিশেষে ১৫-২০ লাখ টাকা নেওয়ার তথ্য মেলে।

দুদক সূত্রে আরও জানা যায়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়োগ পরীক্ষায় উচ্চ নম্বরপ্রাপ্ত অধিকাংশ পরীক্ষার্থীর সরবরাহ করা উত্তরপত্র বর্তমান উত্তরপত্র দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছে বলে অনুসন্ধানে প্রমাণ পাওয়া গেছে। নিয়োগ কমিটির সভাপতি মো. হাসান ইমাম লিথোকোড ফরমের ছেঁড়া অংশ ও সদস্য সচিব আ ফ ম আখতার হোসেন গোপনীয়ভাবে খাতা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। মো. হাসান ইমামের পিএ আহসান সাইদ, পিএ আবু সোহেল এবং এও কবির আহমেদ ও আক্তারুজ্জামান সোহেল নিয়োগ কমিটির সভাপতি ও সদস্য সচিবের সঙ্গে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সরাসরি জড়িত ছিলেন। তারা অপরাধী চক্রের সঙ্গে জড়িত কি না— সেজন্য আরও অনুসন্ধান প্রয়োজন, মনে করছে দুদক।

অন্যদিকে, খিলগাঁও উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র সহকারী শিক্ষক মো. হারুনুর রশিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিত বিভাগের শিক্ষক মো. শাওকত আলী খাতাগুলো নিয়োগ পরীক্ষা গ্রহণের দিন সদস্য সচিব আ ফ ম আখতার হোসেনের কাছ থেকে গ্রহণ করেন। পরীক্ষার পরবর্তী রাত বা দিনে বিকল্প খাতায় নতুন করে প্রশ্নের উত্তর লিখে তা অফিসিয়ালি সরবরাহ করা খাতায় প্রতিস্থাপন করেন। এসব কারণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির নিয়োগ সংক্রান্ত কমিটির সভাপতি মো. হাসান ইমাম, সদস্য সচিব আ খ ম আখতার হোসেন, খিলগাঁও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র সহকারী শিক্ষক মো. হারুনুর রশিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিত বিভাগের চেয়ারম্যান মো. শাওকত আলীর বিরুদ্ধে বিশ্বাসভঙ্গ ও জালিয়াতির অভিযোগ আনতে যাচ্ছেন দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা।

অভিযোগে যা ছিল

করোনাকালে সরকারি হাসপাতালে কারিগরি জনবলের ঘাটতি মেটাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নিয়োগের উদ্যোগ নেয়। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত লিখিত পরীক্ষায় দুই হাজার ৫২১ জন উত্তীর্ণ হন, যা মোট পরীক্ষার্থীর পাঁচ শতাংশের মতো। যারা উত্তীর্ণ হন তাদের মধ্যে ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ খুব ভালো নম্বর পান। এজন্য মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয় খুব কড়াকড়িভাবে।

মৌখিক পরীক্ষায় ২০ নম্বরের মধ্যে ১০ পাওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। কিন্তু এ পরীক্ষায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া যায়নি। এরপরই অভিযোগের বিষয়টি সামনে আসতে শুরু করে। অনিয়মের অভিযোগে নিয়োগ কমিটি থেকে যে দুজন সদস্যকে সরিয়ে দেওয়া হয় তাদের একজন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক (প্রশাসন) আ ফ ম আখতার হোসেন। তার জায়গায় ২০২১ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি নিয়োগ পান ডা. মো. আবুল হাশেম শেখ।

আবুল হাশেম স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবকে ঘুষের প্রস্তাব দেওয়ার বিষয়টি অভিযোগ আকারে জমা দেন। ওই সময় স্বাস্থ্য সচিবের দায়িত্বে ছিলেন আবদুল মান্নান। চিঠিতে ডা. হাশেম দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (পরিকল্পনা অধিশাখা) শ্রীনিবাস দেবনাথ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক (প্রশাসন) ডা. আ খ ম আখতার হোসেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর মোহাম্মদ সোহেল, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) আরিফুর রহমানের ঘুষ ও দুর্নীতির বিষয়টি উল্লেখ করেন। এছাড়া নিয়োগ কমিটির অপর এক সদস্যও নিয়োগ দুর্নীতির বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে অভিযোগ দাখিল করেন বলে জানা যায়।

শেয়ার দিয়ে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন...