দেশের ব্যাংক খাত জুড়ে ব্যাপক ছাটাই আতঙ্ক বিরাজ করছে। চলতি বছর রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর, ব্যাংক খাত সংস্কারে হাত দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর ধারাবাহিকতায় বেশ কয়েকটি ব্যাংকে আগের পর্ষদ সরিয়ে নতুন পর্ষদ দিয়েছে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। এর মধ্যে ব্যাপক সমালোচিত ব্যবসায়ী গ্রুপ এস আলমের কবল থেকে মুক্ত হওয়া ব্যাংকগুলোতে ছাঁটাই আতঙ্ক বেশি।
ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এমন আতঙ্কের কথা জানা গেছে।
সূত্র মতে, ব্যাংক কোম্পানি আইন ভেঙে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম ও তার পরিবারের সদস্যরা নজিরবিহীনভাবে সাতটি ব্যাংক দখলে রেখেছিলো। আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায়ের পরে বাংলাদেশ ব্যাংকও পেয়েছে নতুন গভর্নর। এরপর আলোচিত ব্যাংকগুলোকে সাইফুল আলমমুক্ত করা হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর মালিকানা এস আলমের হাতে যাওয়ার পর থেকে ব্যাপক ঋণ অনিয়ম হয়। পাশাপাশি এসব ব্যাংকে ব্যাপক অনিয়ম করে কোনরকমের পরীক্ষা ছাড়াই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগ দেওয়া হয়। এই কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বড় অংশেরই বাড়ি চট্টগ্রাম, বিশেষ করে এস আলমের নিজ উপজেলায়।
বিভিন্ন ব্যাংকের মালিকানায় থাকা অবস্থায় অনিয়ম করে নিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করেছে এস আলম গ্রুপ। ইতিমধ্যে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড (এসআইবিএল) বিতর্কিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপ নিয়ন্ত্রিত পর্ষদের নিয়োগ দেওয়া ৫৭৯ কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করেছে ব্যাংকটির বর্তমান পর্ষদ।
অভিযোগ আছে, পরীক্ষা ছাড়াই তাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। নিয়োগপ্রক্রিয়া আইনসম্মত ছিল না। বর্তমানে ব্যাংকটির ৪ হাজার ৭০০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে প্রায় ২ হাজার জনই চট্টগ্রামের। ২০২৪ সালে ৫৭৯ কর্মকর্তাকে শিক্ষানবিশ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এসব নিয়োগে কোনো ধরনের বিজ্ঞপ্তি, পরীক্ষা, সার্টিফিকেট যাচাই-বাছাই করা হয়নি।
সম্প্রতি এসআইবিএল ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, চাকরিচ্যুত কর্মকর্তাদের অধিকাংশ চট্টগ্রামের একটি বিশেষ এলাকার। পরীক্ষা ছাড়াই তাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। ফলে পুরো প্রক্রিয়াটি আইনসম্মত ছিল না।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, কর্মকর্তাদের ইচ্ছেমতো চাকরিচ্যুত করা যাবে না বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা রয়েছে, তা এখনো বহাল আছে। তবে কোনো নির্দিষ্ট ব্যাচের নিয়োগপ্রক্রিয়ায় যদি অনিয়ম হয়ে থাকে, তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, ইউনিয়ন ব্যাংক, কমার্স, গ্লোবাল ইসলামীসহ আরও কয়েকটি ব্যাংকও এখন কর্মী ছাঁটাইয়ের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে।
গত আগষ্টে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার সরকারের আমলে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদের দখলে ছিলো ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকও (ইউসিবি)। বেসরকারি খাতের এ ব্যাংকটিরও শতাধিক কর্মকর্তাকে বাদ দেওয়ার তালিকা চূড়ান্ত হয়েছে। জানা গেছে, এ ব্যাংকটির বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন।
২০১৭ সালে পারটেক্স গ্রুপের প্রতিনিধিদের ইউসিবি ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয়। এরপর ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আসেন রুকমিলা জামান। কিন্তু তিনি যুক্তরাজ্যে অবস্থান করায় মূলত তাঁর স্বামী সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীই ব্যাংকটি পরিচালনা করতেন। সরকার বদলের পর বাংলাদেশ ব্যাংক আগের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিলে নতুন চেয়ারম্যান হন অনন্ত গ্রুপের শরীফ জহির।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০২২ সালের জানুয়ারিতে এক প্রজ্ঞাপনে নির্দেশনা দেয়, শুধু নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জন করতে না পারা বা অদক্ষতার অজুহাতে ব্যাংক-কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রাপ্য পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। অর্থাৎ সুনির্দিষ্ট ও প্রমাণিত কোনো অভিযোগ না থাকলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত করা বা পদত্যাগে বাধ্য করা যাবে না।