সেপ্টেম্বর ২২, ২০২৪

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, কিছু ব্যাংক নাজুক অবস্থায় থাকলেও আগামী এক বছরের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতির চেহারা পাল্টে ফেলতে পারব। সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন।

গভর্নর বলেন, আমাদের প্রথম দায়িত্ব দেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে আসা। যাতে মূল্যস্ফীতি ৫-৬-৭ শতাংশের মধ্যে থাকে। এছাড়াও ডলারের বিনিময় হার ১২০ টাকার আশপাশে স্থির রাখা। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরেকটু স্থিতিশীল করে আস্তে আস্তে বাড়ানো।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, অর্থনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান দায়িত্ব মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা। আগে নীতিগত ভুলভ্রান্তির কারণে মূল্যস্ফীতি কমার বদলে বেড়ে গিয়েছিল। এখানে আমাদের কাজ করতে হচ্ছে। দুই বছর ধরে ব্যালান্স অব পেমেন্টে একটা বড় ধরনের অস্থিতিশীলতা আছে। এটা সামাল দিতে হবে। আশা করছি, এক বছরের মধ্যে অর্থনীতির চেহারা পাল্টে ফেলতে পারব।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর বলেন, আমাদের মূল টার্গেট হচ্ছে চলতি অর্থবছরের শেষ নাগাদ মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশে নামিয়ে আনা। এপ্রিল-মের মধ্যেই লক্ষ্য পূরণ হবে। তার পরে আমরা ৬ অথবা ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার চেষ্টা করব। আমরা যদি মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে পারি, তাহলে অবশ্যই সুদহার কমিয়ে আনতে পারব। সুদহার কমে এলে বাজারে একটা চাহিদা তৈরি করে ঋণের প্রবাহ বাড়াতে পারব।

তিনি বলেন, দেশে বিদ্যমান নীতি সুদহার ৮ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে ৫০ ভিত্তি পয়েন্ট বাড়িয়ে নতুন সুদহার নির্ধারণ করা হয়েছে। এ মাসে সেটা ৯ দশমিক ৫০ শতাংশে নিয়ে যাব, পরবর্তী মাসে ১০ শতাংশে নিয়ে যাব। এটা আমাদের পূর্বপরিকল্পনা।

এই গভর্নর আরো বলেন, মূল্যস্ফীতি বড়লোককে আরও বড়লোক করে, গরিবকে গরিব করে। যাদের সম্পদ আছে তাদের সম্পদের পরিমাণ বেড়ে যায়। যারা আয়ের ওপর নির্ভরশীল তাদের আয়টা কমে যায়। ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। দেশের ইতিহাসে ৪-৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতি কখনোই হয়নি। আমরা যদি করতে পারি, তাহলে সরকারের জন্য একটি বড় অর্জন হবে। সে লক্ষ্যেই আমরা কাজ করছি।

বৈধপথে প্রবাসী আয় বাড়ানোর বিষয়ে তিনি বলেন, ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার এখন ১২০ টাকা। তিন মাস ধরেই এটা স্থিতিশীল আছে। খোলাবাজারের সঙ্গে এখন আর পার্থক্য নেই। প্রবাসী আয়ে প্রণোদনা দেওয়ার পর ব্যাংকের ডলারের দাম খোলাবাজারে কম। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটা কখনো হয়নি। এখন বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠালে অবৈধ চ্যানেলের চেয়ে বেশি টাকা পাবেন। এ জিনিস প্রথম আমরা দেখতে পাচ্ছি। এটা হচ্ছে ইতিবাচক দিক

এখন পর্যন্ত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো রিজার্ভ আমাদের আছে উল্লেখ করে আহসান এইচ মনসুর বলেন, এটা অবশ্যই সেভাবে রাখতে হবে অথবা বাড়াতে হবে। অতীতে ১ থেকে ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ থেকে বাজারে ছাড়া হতো। গত এক মাসে আমি ১ ডলারও বাজারে ছাড়িনি। উল্টো কিছু কিনেছি। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার বাজারটা কিন্তু বড়। আমদানি ব্যয় মেটাতে প্রয়োজন হয় ৭৫-৮০ বিলিয়ন ডলার। সেবা খাতে পরিশোধ হয় আরও ৫ বিলিয়নের মতো। সব মিলিয়ে আমাদের ৯০ বিলিয়নের মতো খরচ হয়। সেখানে আমাদের রপ্তানি আয় থেকে আসে ৫০ বিলিয়ন ডলারের মতো। রেমিট্যান্স আছে প্রায় ২৪ বিলিয়ন। সেবা খাতে আসে আরও ৫-৬ বিলিয়নের মতো। আমি চাই এ ৮০ বিলিয়ন থেকেই যেন সবাই তাদের ব্যয় মেটাতে পারেন।

দেশে থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরানোর বিষয়ে গভর্নর বলেন, একটি বড় শিল্প গোষ্ঠী ২০১৭ সাল থেকে সাত বছরে সবকটি ইসলামী ব্যাংকই কবজা করেছিল। নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ব্যাপক সম্পদ বের করে বিদেশে পাচার করেছে। তাদের সম্পদের একটা অংশ এখনো দেশে আছে। আমাদের ধারণা, একটা পরিবার হয়তো ১ লাখ ১৫ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে। সঙ্গে আরও দুই-তিনটা গোষ্ঠী মিলে ২ লাখ কোটি টাকার মতো বের করে বিদেশে পাচার করেছে। সম্পদগুলো আমরা কীভাবে ফিরিয়ে আনতে পারি সেটা চেষ্টা করব।

দেশের ইসলামী ব্যাংকগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে এই গভর্নর বলেন, দেশে দুটি শক্তিশালী ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হবে। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড নামে একটি ব্যাংক আছে। সেটায় ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনকে বিনিয়োগের অনুরোধ করেছি। তারা ৫ থেকে ১০ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা নিলে অন্যরা নেবে ৫০ শতাংশ শেয়ার। এতে ব্যাংকটির কমপ্লায়েন্স পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন হবে। আবারও ঘুরে দাঁড়াবে। এ ছাড়া ছোট ছোট ইসলামী ব্যাংকগুলো একীভূত করে আরও একটি বড় শক্তিশালী শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক তৈরি করা হবে।

আহসান এইচ মনসুর আরো বলেন, ব্যাংক খাতের জন্য একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা থাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একাধিক নিয়ন্ত্রক হলে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। ব্যাংক খাতের সংস্কারের অংশ হিসেবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে ব্যাংক খাতকে অবমুক্ত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে শক্তিশালী করা হবে।

শেয়ার দিয়ে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *