

বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত বাস্তবায়নে বাজারভিত্তিক সুদহার ব্যবস্থা ফের চালু করতে যাচ্ছে। শীঘ্রই ব্যাংক ঋণের সীমা তুলে নেয়া হবে। ব্যাংকগুলো চাহিদা ও যোগানের ভিত্তিতে ব্যাংক ঋণের সুদহার ঠিক করবে। ঋণ সুদে কোনো বিধি নিষেধ থাকবে না বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।
রোববার (৫ মে) রাজধানীর একটি হোটেলে ‘ফার্স্ট ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স ঢাকা’ শীর্ষক দুই দিনের সম্মেলনের প্রথম দিনের এক সভায় তিনি এ কথা বলেন।
গভর্নর বলেন, শীঘ্রই ব্যাংক ঋণের সুদহার সীমা তুলে নিয়ে বাজারভিত্তিক করা হবে। ২০২০ সালের এপ্রিলের আগে ব্যাংক খাতে সুদহার ছিল ক্ষেত্র বিশেষে ২২ শতাংশ পর্যন্ত।
এদিন গভর্নরের কথায় তা স্পষ্ট হয়ে গেল যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘স্মার্ট রেট’ র্নিধারণ থেকে সরে আসলো। চলতি মাস থেকেই তা কার্যকর হতে পারে। স্মার্ট রেট উঠে গেলে সুদহার নির্ধারণে ২০২০ সালের এপ্রিলের আগের অবস্থানে চলে যাবে দেশের ব্যাংক খাত।
তবে কবে নাগাদ ঋণ সুদহারের বর্তমান সীমা তুলে নেওয়া হবে তার কোনো নির্দিষ্ট দিনক্ষণ জানাননি আব্দুর রউফ তালুকদার।
মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতির মধ্যে সমন্বয় করা নিয়ে ‘‘ফিসক্যাল অ্যান্ড মনিটরি পলিসিস ইন দ্যা ইভলভিং ইকোনোমিক অর্ডার’’ শীর্ষক সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক তিন গভর্নর, সাবেক সচিব ও অর্থনীতিবিদরা অংশগ্রহণ করেন।
এ সেসনে মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতির মধ্যে সমন্বয় না হওয়ার দুর্বলতা ও তার সমাধান নিয়ে বিভিন্ন প্রস্তাবনা নিয়ে আলোচনা হয়।
বর্তমানে ‘স্মার্ট (সিক্স মান্থস মুভিং এভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিলস- স্মার্ট)’ এর সঙ্গে সর্বোচ্চ তিন শতাংশ মার্জিন যোগ করে ঋণ সুদ ঠিক করতে পারে ব্যাংক।
গত এপ্রিল মাসের জন্য স্মার্ট রেট ছিল ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশ। এরসঙ্গে তিন শতাংশ যোগ করলে গ্রাহক পর্যায়ে ঋণ সুদহার দাঁড়ায় সর্বোচ্চ ১৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতির সিদ্ধান্তের আলোকে গত ২০২৩ সালের জুলাই মাসে ‘স্মার্ট’ সুদহার চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই মাসটিতে প্রথমবার জুন মাসের জন্য ‘স্মার্ট’ রেট ছিল ৭ দশমিক ১০।
প্রতি ছয় মাসের ট্রেজারি বিল ও বন্ডের গড় সুদহার বের করে হিসাব করা হয় ‘স্মার্ট’ রেট। প্রতি মাসের শেষে বা প্রথম দিনে স্মার্ট সুদহার কতো হবে তা জানিয়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। যা পরবর্তী মাসে বিতরণ করা নতুন ঋণের জন্য প্রযোজ্য হবে।
ঘটা করে স্মার্ট রেট প্রকাশ করার কথা জানালেও চলতি মে মাসের জন্য স্মার্ট রেট কতো হবে তা এখনো জানায়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি মাসের ৫ দিন অতিবাহিত হলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্মার্ট রেট প্রকাশ করেনি।
উচ্চ সুদের কারণে ব্যাংক খাতে খেলাপী ঋণ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি ব্যবসায় খরচ বাড়ছে; এমন যুক্তি দেখিয়ে ব্যবসায়ীদের কথায় ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ব্যাংক ঋণের সুদহার নামিয়ে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ ঠিক করে দেন।
ওই সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন ফজলে কবির। ব্যাংক খাতে এ ঘটনা ছয়-নয় সুদহার নামে পরিচিত। সরকারের এমন সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে আসছিলেন অর্থনীতিবিদরা।
পরবর্তীতে মূল্যস্ফীতির উচ্চ হার সামাল দেওয়া ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) এর ঋণ নেওয়ার পরে সংস্থাটির শর্তে ঋণ সুদহার ৯ শতাংশ থেকে সরে আসে বাংলাদেশ গত বছরের জুলাই মাসে।
তখন থেকেই প্রতিমাসে স্মার্ট রেট প্রকাশ করে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত বছরের জুন ও জুলাইয়ে মাসে স্মার্ট সুদহার ছিল ৭ দশমিক ১০ শতাংশ, অগাস্টে তা সামান্য বেড়ে ৭ দশমিক ১৪ শতাংশ, সেপ্টেম্বরে ৭ দশমিক ২০ শতাংশ, অক্টোবরে ছিল ৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ, নভেম্বরে ৭ দশমিক ৭২ শতাংশ, ডিসেম্বরে ৮ দশমিক ১৪শতাংশ, জানুয়ারিতে যা ছিল ৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ, ফেব্রুয়ারিতে ছিল ৯ দশমিক ৬১ শতাংশ এবং মার্চে ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশ ছিলো।
এদিন বিনিময় হার প্রসঙ্গে আব্দুর রউফ বলেন, ক্রলিং পেগ পদ্ধতিতে বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্গে স্থানীয় মুদ্রা টাকার বিনিময় হার নির্ধারণ করা হবে। এরপরই বাজারভিত্তিক বিনিময় হার ব্যবস্থায় যাবে বাংলাদেশ।
সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতির চেয়ে সরকারের র্ব্যথতা বেশি। মন্ত্রণালয়গুলো একেক রকম ঘোষণায় বাজারের সরবরাহ ব্যবস্থা প্রভাবিত হয়েছে।
মুদ্রানীতির কার্যকর ফল পেতে বাংলাদেশকে নীতিগত বিষয়ে শক্ত অবস্থানে থাকার পরামর্শ দিয়ে সাবেক এই গভর্নর বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্বশাসন তো দেওয়া আছে। সবকিছু পুরোটা দিয়ে দেওয়া হয় না, অর্জন করতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংককে তা এখন অর্জন করতে হবে।
তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতে সরকারসহ সব সময় প্রভাবশালী গোষ্ঠী প্রভাব বিস্তার করবেই। রাজনৈতিক প্রভাব থেকে বের হওয়া যায় না। যতোটুকু সহনশীল করা যায়, তা মানা। এটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক করতে পারে নিজের অবস্থান ধরে রেখে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সেই সক্ষমতা আছে বলে মনে করি। এখন দরকার তা মেনে চলা।
মূল্যস্ফীতের তাপ মানুষের গায়ে লাগছে মন্তব্য করে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান বলেন, বাজারে গেলে শরীরে মূল্যস্ফীতির তাপ লাগে। যারা বাজারে যান তারা বুঝতে পারেন। যেভাবেই হোক মূল্যস্ফীতি একটু কমাতে হবে।
সাবেক গভর্নর ফজলে কবির বলেন, মূল্যস্ফীতির আঘাত সবচেয়ে বেশি লাগে দরিদ্র ও নির্ধারিত আয়ের মানুষের। মূল্যস্ফীতি কারো জন্যই ভালো না। এটি ব্যবসায়ীদের জন্য ভালো না।
সাবেক সচিব মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী বলেন, এভাবে ২০ হাজার কোটি টাকার সরকারের বন্ড বাজারে এক লাখ কোটি টাকার কাজ করছে। এটিও টাকা ছাপানোর মতো। এভাবে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দিলে মূল্যস্ফীতি কিভাবে কমবে’’, প্রশ্ন রাখেন তিনি।
এর উত্তরে আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, গত বছরের সেপেটম্বর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দিচ্ছে না। বাণিজ্যিক ব্যাংক ঋণ দিচ্ছে। আর বন্ড ছাড়া মানে টাকা ছাপানো কি, না তা গবেষণার দাবি রাখে।
অর্থমন্ত্রনালয়ের সাবেক সচিব মোহাম্মদ তারেক বলেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এর সক্ষমতা বাড়াতে হবে। নইলে আগামী বাজেটেও সরকারকে বেশিরভাগ অর্থ ধার করতে হবে।