নভেম্বর ২৪, ২০২৪

উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম, দলীয়করণ ও দুর্নীতি রোধসহ উচ্চশিক্ষা সংস্কারে ১৫টি প্রস্তাব পেশ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকসমাজ। রবিবার (১৫ সেপ্টেম্বর) এ প্রস্তাব পেশ করা হয়।

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজের সাথে তাঁর দফতরে সাক্ষাৎকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকসমাজের ০৯ সদস্যের প্রতিনিধিদল এ প্রস্তাব পেশ করেন।

প্রতিনিধিদলের সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. খোরশেদ আলম প্রস্তাবসমূহ পাঠ করে শোনান।

এসময় ইউজিসি সদস্য অদ্যাপক ড. মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান ও অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন, জনসংযোগ ও তথ্য অধিকার বিভাগের পরিচালক ড. শামসুল আরেফিনসহ ইউজিসি’র সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ শিক্ষকসমাজের প্রস্তাবসমূহ বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের আশ্বাস দেন। শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গৃহীত যেকোন পদক্ষেপ বাস্তবায়নে ইউজিসি প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করা হবে বলেও তিনি প্রতিনিধি দলকে আশ্বস্ত করেন। এছাড়াও, ইউজিসি চেয়ারম্যান গবেষণা প্রকল্পের মূল্যায়নে কোন প্রকার অস্বচ্ছতা থাকলে তা নিরসন এবং গবেষণার অর্থ দ্রুত ছাড়করণের প্রতিশ্রুতি দেন।

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন তাঁর বক্তব্যে বলেন, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্ব-উদ্যোগে শিক্ষকসমাজের সংস্কার প্রস্তাবসমূহ বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। এক্ষেত্রে ইউজিসি প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করবে। তিনি উচ্চশিক্ষা সংস্কারে ইউজিসি’র সক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কথাও তাঁর বক্তব্যে তুলে ধরেন। ইউজিসি’র ক্ষমতায়ন প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বলেন, শিক্ষা ব্যবস্থা এমন হতে হবে যা পিছিয়ে পড়া মানুষের কথা বলবে এবং সমাজে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে। তিনি উচ্চশিক্ষায় গবেষণাকে মূলধারায় নিয়ে আসার উদ্যোগ নিতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহবান জানান।

প্রতিনিধিরা তাঁদের বক্তব্যে উল্লেখ করেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যমান গবেষণা কেন্দ্রগুলোতে অর্থ বরাদ্দ বাড়ালে এবং অবকাঠামোগত কিছু সংস্কার করা হলে সেখান থেকে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা সমৃদ্ধি সম্ভব হবে। তাঁরা গবেষণায় উৎসাহ দেওয়ার জন্য প্রতিবছর ১০০ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘ইউজিসি রিসার্চ এওয়ার্ড প্রদান করার প্রস্তাব দেন। পাশাপাশি, দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষকদের জন্যও ‘ইউজিসি পিএইচডি রিসার্চার এওয়ার্ড’ চালু করা যেতে পারে বলেও তাঁরা মত প্রকাশ করেন।

১৫টি প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে-

১) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সংস্কার প্রস্তাবটি (খসড়া) প্রস্তুত করা হলেও ইউজিসি চাইলে এটি ১৯৭৩ আদেশভুক্ত বাকি ৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ে, এমনকি আংশিকভাবে অপরাপর বিশ্ববিদ্যালয়ে, প্রয়োগ করার কথা বিবেচনা করতে পারে।

২) বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে রাষ্ট্রীয় বরাদ্দ বাড়াতে ইউজিসি সরকারের ওপর চাপ তৈরি করতে পারে। গবেষণাখাতে ইউজিসি কর্তৃক বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ বাড়ানো এবং তা আমলাতান্ত্রিকতা ও অনিয়মমুক্ত করা প্রয়োজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যমান গবেষণা কেন্দ্রগুলোতে অর্থ বরাদ্দ বাড়ালে এবং (অব)কাঠামোগত কিছু সংস্কার করা হলে সেখান থেকে আরও বে‌শি আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করা সম্ভব বলে মনে করে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকসমাজ’।

৩) গবেষণায় উৎসাহ দেয়ার জন্য প্রতিবছর ১০০ জন (সংখ্যাটি কম-বেশি হতে পারে) বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘ইউজিসি রিসার্চ অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান করা যেতে পারে। পাশাপাশি, দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষকদের জন্যও ‘ইউজিসি পিএইচডি রিসার্চার অ্যাওয়ার্ড’ চালু করা যেতে পারে।

৪) প্রতিটি একাডেমিক ফিল্ড/ডিসিপ্লিনের টপ কনফারেন্সে অংশ নেয়ার জন্য ‘ইউজিসি কনফারেন্স ট্র্যাভেল অ্যাওয়ার্ড’ প্রবর্তন করা যেতে পারে।

৫) পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে যৌথ গবেষণার (collaborative research) উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরের বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেও ভিজিটিং ফেলো, স্কলার ও ফ্যাকাল্টি এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম চালু করা যেতে পারে।

৬) বহির্বিশ্বের (বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহ) অভিজ্ঞতা রেফারেন্স হিসেবে গ্রহণ করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বিদ্যমান বেতন কাঠামো রিভিয়্যূ করা এবং তা বৃদ্ধির ব্যাপারে ইউজিসির উদ্যোগ নিতে পারে।

৭) বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে গৃহীত বিভিন্ন কৌশলপত্র পরিকল্পনা ও প্রণয়নে অংশীজন হিসেবে পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞ শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।

৮) পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়কে বিভিন্ন নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।

৯) বিশ্ববিদ্যালয় পরিসরে নিপীড়ন, নির্যাতন ও বৈষম্য রোধে শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য ইউজিসি একটি ‘কোড অব কনডাক্ট’ তৈরি করে নির্দিষ্ট সময় পর পর তার উপর ট্রেনিং (অনলাইন/অফলাইন) এর ব্যবস্থা করতে পারে।

১০) সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের (প্রভাষক ও সহকারী অধ্যাপক) অভিজ্ঞ/বিশেষজ্ঞ শিক্ষক/শিক্ষাবিদের মাধ্যমে বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে শিক্ষার দর্শন, শিক্ষাদান পদ্ধতি, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক, ইত্যাদি প্রসঙ্গ থাকতে পারে।

১১) বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যমান ভর্তি পরীক্ষাকে একটি সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনা এবং তা অধিকতর শিক্ষার্থীবান্ধব করা প্রয়োজন।

১২) শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম, দলীয়করণ ও দুর্নীতি রোধে ইউজিসি একটি সমন্বিত দিকনির্দেশনা প্রস্তুত ও প্রয়োগ করার প্রস্তাব দিতে পারে।

১৩) স্বল্প-মধ্যম-র্দীঘমেয়াদী পরিকল্পনার মধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি রিসার্চ ইউনিভার্সিটিতে উন্নীত করতে ইউজিসি কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারে।

১৪) নিরপেক্ষ সমীক্ষার মাধ্যমে বাজারের চাহিদা এবং একাডেমিক প্রয়োজন যাচাই করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ/ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী সংখ্যা ও বিদ‌্যমান কোর্স-কা‌রিকুলাম পুনর্বিন্যাসে ইউজিসি যুগোপযোগী পরামর্শ দিতে পারে।

১৫) উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ নিয়োগ রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপমুক্ত করতে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকসমাজ’ ১৯৭৩ সালের আদেশ সংশোধনের সুপারিশ করছে। এক্ষেত্রে ইউজিসি সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।

শেয়ার দিয়ে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন...