২০২৩ সালে ফিনল্যান্ডের সরকার ‘ট্যালেন্ট বুস্ট’ নামে একটি প্রকল্প চালু করেছে। তারা ইইউ, ইইএ ছাড়াও চারটি নির্দিষ্ট দেশ; ভারত, ব্রাজিল, ভিয়েতনাম এবং ফিলিপাইন থেকে কর্মীদের সক্রিয়ভাবে নিয়োগ করতে চায়। এই নিয়োগের জন্য ‘ট্যালেন্ট বুস্ট’ নামে পাঁচ বছরের প্রোগ্রাম চালু করা হয়েছে।
ফিনিশ শহর ল্যাপল্যান্ড সুমেরুবৃত্তের মধ্যে অবস্থিত, যা ফিলিপাইনের রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়ার থেকে অনেকটাই আলাদা। কিন্তু ল্যাপল্যান্ডে বসবাসকারী ১৪ জন ফিলিপিনো নিজের কর্মক্ষেত্রকেই বাড়ি হিসাবে ভাবেন।
স্থানীয় ফিনিশ পাবলিক সার্ভিস ব্রডকাস্টার ওয়াইএলই বুধবার এক প্রতিবেদনে বলেছে, ল্যাপল্যান্ডে রিটেল খাতে কাজ করা ফিলিপিনো কর্মীদের দেখে বোঝা যায় দেশের শ্রমশক্তি পরবর্তীতে কেমন হতে পারে। এই কর্মীরা সবাই তরুণ এবং বিদেশি।
ফিলিপাইনের নিয়োগকারী সংস্থা বারোনার সঙ্গে ল্যাপল্যান্ডের স্থানীয় রিটেল সংস্থা আরিনার একটি চুক্তি হয়েছিল। সেই চুক্তির কারণে ল্যাপল্যান্ডে কাজ করতে এসেছেন ফিলিপিনোরা।
এই নিয়োগ কার্যক্রম এক বছর আগে শুরু হয়েছে। পাঁচ মাসের ভাষা কোর্স এবং প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি প্রশংসাপত্র সুরক্ষিত করতে সহায়তা করে এই প্রকল্প। এর ফলে ফিনল্যান্ডে স্থানান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনা তুলনামূলক দ্রুততর হয়েছে। এই প্রকল্পের ফলে নতুন বিদেশি কর্মীদের ফিনল্যান্ডে একীভূত হতে সাহায্য করা হবে। এর মাধ্যমে নতুন দেশটিতে বাসস্থান খুঁজে পেতে এবং করের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বুঝতে সাহায্য করা হয়।
আরিয়ানার মানবসম্পদ ব্যবস্থাপক মিন্না স্যালোনেন ওয়াইএলইকে বলেন, ফিনল্যান্ডে ইতিমধ্যে বসবাস করছেন, এমন মেধাবী তরুণদের তারা নিয়োগ করতে চাইলেও তা কঠিন। তার কথায়, ‘‘কয়েকটা জায়গায় রিটেল খাতে চাকরির জন্য ন্যূনতম উৎসাহ নেই।’’
এ দেশে বয়স্কদের সংখ্যা অনেক বেশি। অল্পবয়সী ফিনিশ নাগরিকদের পড়াশোনা বা অন্য কোথাও কাজ করার জন্য চলে যাওয়ায় স্থানীয় প্রতিভাবান তরুণদের নিয়োগ করা যায় না। ওয়াএলইর প্রতিবেদন অনুযায়ী, নিয়োগকর্তা এবং কর্মী উভয়ের জন্য ‘ট্যালেন্ট বুস্ট’ ইতিবাচক বলেই মনে করা হচ্ছে।
ল্যাপল্যান্ডের পেলো এস মার্কেটে কাজ করা ফিলিপিনো জেভ ফার্নান্দেজ বলেন, ফিনল্যান্ড আমার স্বপ্নের দেশ। আমি এখানে ক্যারিয়ার গড়ে নিতে চাই।
পেলো স্টোরের ম্যানেজার ইয়ানা ইয়ারভেনপা ফিলিপিনো কর্মীদের কাজের নীতি এবং আচরণের প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘তারা কঠোর পরিশ্রমী, সুখী, হাসিখুশি। গ্রাহকরা তাদের পছন্দ করেন। আমার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, তারা কাজের ব্যাপারে নিখুঁত।’’
• শ্রমিকের অপ্রতুলতা
অনেক ইউরোপীয় দেশের মতো ফিনল্যান্ডের রিটেল খাতে এবং স্বাস্থ্যসেবার মতো প্রয়োজনীয় পরিষেবাগুলো টিকিয়ে রাখার জন্য প্রচুর শ্রমিকের প্রয়োজন। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২১ সালের শেষে, আনুমানিক এক লাখ ৯৬ হাজার পার্সোনাল কেয়ার কর্মী চাকরি পেয়েছেন ফিনল্যান্ডে। যার প্রায় ৮ দশমিক ৪ শতাংশ অর্থাৎ ১৬ হাজার ৫০০ জন বিদেশি। পরিচ্ছন্নতাকর্মী, সহায়তাকর্মীদের মধ্যে বিদেশিই বেশি ছিল।
• ট্যালেন্ট বুস্ট প্রোগ্রাম
শ্রমের ঘাটতি মোকাবিলা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর লক্ষ্যে, ফিনিশ সরকার ‘ট্যালেন্ট বুস্ট’ প্রোগ্রাম চালু করেছে। এতে পাঁচ বছরের (২০২৩ থেকে ২০২৭) কাজ এবং ইইউ ও ইইএর পাশাপাশি চারটি রাষ্ট্রের মানুষদের আকৃষ্ট করার জন্য শিক্ষা-ভিত্তিক কর্মসূচি নেওয়া হয়। টার্গেট দেশগুলো হলো, ফিলিপাইন, ব্রাজিল, ভারত এবং ভিয়েতনাম।
উচ্চমাত্রার দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও ফিনল্যান্ডের শ্রমবাজারে দক্ষ শ্রমিকের উল্লেখযোগ্য ঘাটতি রয়েছে। এটা মোকাবেলার জন্য, প্রধানমন্ত্রী অর্পোর সরকার ফিনল্যান্ডে বসবাসকারী বেকার চাকরিপ্রার্থীদের নিয়োগ এবং অভিবাসনের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের ওপর জোর দিচ্ছেন। সংশোধিত ট্যালেন্ট বুস্ট প্রোগ্রাম ইইউ ও ইইএ দেশগুলো থেকে নিয়োগকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। এছাড়াও নন-ইইউ দেশগুলো থেকে আন্তর্জাতিক নিয়োগের প্রচার করছে।
প্রোগ্রামের বিভিন্ন উদ্যোগে এমন কৌশল নেওয়া হয়েছে, যা মানুষকে শুধু ফিনল্যান্ডে আসতেই সাহায্য করবে না বরং তাদের এ দেশে থাকতে উৎসাহিত করবে।
মসৃণ অভিবাসন প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে বসবাসের অনুমতি প্রক্রিয়াকরণের সময় সংক্ষিপ্ত করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের জন্য এক সপ্তাহে অনুমতি প্রক্রিয়াকরণ এবং অন্যান্য কর্মীদের জন্য ৩০ দিনে অনুমতির লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। সিস্টেমের অপব্যবহার প্রতিরোধ এবং সরকারি নিয়ম মেনে চলা নিশ্চিতের ব্যবস্থাও বাস্তবায়িত হচ্ছে।
বিদেশি কর্মীদের ফিনল্যান্ডে থাকার সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে এমন বিষয়গুলো নিয়ে ভেবে দেখছে সরকার। যেমন অ্যাক্সেসযোগ্য ব্যাংকিং পরিষেবা, ইংরেজি-ভাষা শিক্ষা, এছাড়াও ফিনিশ ও সুইডিশ শেখার জন্য সহায়তা ইত্যাদি।
• বিদেশি শ্রমিক ছাড়া কাজ হবে না
কর্পোরেট জায়ান্ট এস গ্রুপ ফিনল্যান্ডের বৃহত্তম রিটেল গোষ্ঠী। বিদেশি কর্মীদের সমর্থন করছে তারা। সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের কথাও ভাবা হচ্ছে। সংস্থার ত্রৈমাসিক ম্যাগাজিনের গ্রীষ্মের সংস্করণে বিদেশি কর্মীদের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রচ্ছদের অনুলিপিতে লেখা ছিল, ‘‘সবসময় ফিনিশে পরিষেবা পাওয়া যাবে না। এতে অভ্যস্ত হতে হবে। ফিনল্যান্ড বিদেশি কর্মী ছাড়া কাজ করতে পারবে না।’’
এই ম্যাগাজিনের দুই লাখেরও বেশি সার্কুলেশন রয়েছে বলে জানা গেছে। ওয়াইএলইর প্রতিবেদন বলছে, কোম্পানি আরও বেশি বিদেশি কর্মী নিয়োগের পরিকল্পনা করছে। সংস্থাটি চায় গ্রাহকরা এই ধারণায় অভ্যস্ত হয়ে উঠুন। সংস্থার হিউম্যান রিসোর্স অধিকর্তা লেহটোভুরি ওয়াইএলইকে বলেন, গ্রাহকদের জন্য ম্যাগাজিনের বার্তা দেওয়া, যাতে তারা বিষয়টা বুঝতে পারেন।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, অনেক বিদেশি কর্মীদের ফিনল্যান্ডে ইতিবাচক অভিজ্ঞতা রয়েছে এবং তারা এ দেশে থাকতে চান। সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ৪০ শতাংশ কর্মী বলেন, তারা কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যের সম্মুখীন হন,আর সেটা মূলত ভাষার কারণে।