সেপ্টেম্বর ৮, ২০২৪

আনোয়ারুল আজীমকে হত্যার পর শরীর খণ্ড খণ্ড করা হয়। এরপর হাড় ও মাংস আলাদা করে হলুদের গুঁড়ো মিশিয়ে সেগুলো ব্যাগে ভরে বের করা হয় ওই বাসা থেকে। তবে কোথায় মরদেহের টুকরোগুলো ফেলা হয়েছে তা এখনো স্পষ্ট নয়।

বৃহস্পতিবার (২৩ মে) বিকেলের দিকে ডিবি কার্যালয়ে সাংবাদিকদের ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যার রোমহর্ষক বর্ণনা দিয়ে এ সব তথ্য জানান ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ।

ডিবিপ্রধান বলেন, ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা দীর্ঘদিনের। আনারকে হত্যার পরিকল্পনা করেন তার বাল্যবন্ধু ও ব্যবসায়ীক পাটনার আক্তারুজ্জামান শাহীন। শাহীনের পরিকল্পনায় হত্যার কাজটি করেন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা আমানউল্লাহ আমান ওরফে শিমুল। দুই থেকে তিন মাস আগেই এমপি আনারকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। তারা পরিকল্পনা করেছিলেন ঢাকায় হত্যা করবেন। মাস্টারমাইন্ড আখতারুজ্জামানের দুই বাসার মধ্যে একটি গুলশানে, অন্যটি বসুন্ধরায়। এ দুই বাসায়ই হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। আনার হত্যার নেপথ্যে রাজনীতি বা অন্য যে কারণই থাকুক না কেন বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু হত্যাকারীরা পারেননি। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তারা কলকাতায় গত ২৫ এপ্রিল একটি বাসা ভাড়া নেন। তারা ৩০ এপ্রিল ওই বাসায় ওঠেন। যিনি হত্যার পরিকল্পনা করেছেন তিনি ও আরেকজনসহ মোট তিনজন বিমানযোগে কলকাতার ভাড়া বাসায় ওঠেন। তারা দুই মাস ধরে খেয়াল রাখছেন কখন আনারকে কলকাতা আনা যাবো। ১২ মে আনার বন্ধু গোপালের বাসায় যান। সেখানে আরও দুজনকে হায়ার করা হয়। তারা ওই বাসায় আসা-যাওয়া করবেন। তারা হলেন জিহাদ বা জাহিদ ও সিয়াম। মাস্টারমাইন্ড গাড়ি ঠিক করেন। কাকে কত টাকা দিতে হবে, কারা কারা হত্যায় থাকবেন, কার দায়িত্ব কী হবে তা ঠিক করেন। সেগুলো ঠিক করে মাস্টারমাইন্ড আখতার ১০ মে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। নিহত সংসদ সদস্য কলকাতায় যাওয়ার পর ১৩ তারিখ ওই বাসায় যান। যাওয়ার পথে একটি সাদা গাড়িতে করে ফয়সাল নামের এক ব্যক্তি তাকে নিয়ে যায়। গাড়িটি কিছু পথ যাওয়ার পরে হত্যাকারী আমান উল্লাহ সেই গাড়িতে ওঠে। গাড়িটির চালক ছিল রাজা।

তিনি বলেন, সেই বাসায় (নিউ টাউন এলাকার সঞ্জিভা গার্ডেন) যাওয়ার পর মোস্তাফিজসহ তারা বাসায় প্রবেশ করে। বাসাটিতে আগে থেকে জাহিদ ও সিয়াম অবস্থান করছিল। ১৩ তারিখ দুপুরে ২টা ৫১ মিনিটে বাসায় প্রবেশ করেন আনার। এর ৩০ মিনিটের মধ্যেই হত্যা করা হয় তাকে। হত্যার পরে ঘাতকরা সংসদ সদস্যের মোবাইল ফোন দিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তিকে ম্যাসেজ পাঠায়। এরপর তারা মরদেহের হাড় থেকে মাংস আলাদা করে। পরবর্তীতে দুটি ব্রিফকেসে করে জিহাদ ও সিয়াম মরদেহ গাড়িতে করে ফেলে দেয় যাতে আনারের চিহ্ন না থাকে। কাজ শেষ করে ১৫ তারিখ আমানউল্লাহ আমান ও শাহীনের প্রেমিকা শিরিস্তি দেশে ফিরে আসে। সবাই ফিরে আসায় হত্যার মাস্টারমাইন্ড শাহীন বিমানে করে দিল্লি, সেখানে ২ ঘণ্টার ট্রানজিট নিয়ে কাঠমান্ডু যায়। সেখান থেকে অন্য কোনও দেশে চলে যান।

হারুন আরও বলেন, হত্যার বিষয়টি প্রকাশ হওয়ার পরে দেখা গেছে, হত্যাকারীরা তদন্তকারীদের বিভ্রান্ত করতে নিহত সংসদ সদস্যের দুটি মোবাইল ফোন দুই দিকে নিয়ে যায়। এরপর তারা বিভিন্ন জনকে বার্তা পাঠায় ও কল করতে থাকে। এটা করে যাতে তদন্তকারীরা বুঝতে পারে তিনি জীবিত আছেন। এমনকি গত ১৮ তারিখ এমপির ব্যক্তিগত সহকারীকে একটি ম্যাসেজ পাঠায় যাতে বলা হয়– আমি দিল্লি যাচ্ছি। আমার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আছেন। দিল্লির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সঙ্গে আমার একটি মিটিং আছে। এই বার্তাগুলো আমরা যখন পেয়েছি তখনই বুঝতে পেরেছি হত্যাকারীরা নিজেদের আড়াল করতে এই বার্তা পাঠিয়েছে। হত্যাকারীরা দুটি মোবাইল কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চল ও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় পাঠায়। সব কিছু মিলিয়ে তারা এই হত্যাটি করেছে।

উল্লেখ্য, আনোয়ারুল আজীম আনার ঝিনাইদহ-৪ (সদর ও কালীগঞ্জ) আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য। তিনি ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে টানা তিনবার আওয়ামী লীগ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন তিনি। ১২ মে তিনি চিকিৎসার কথা বলে ভারতে যান। ১৪ মে থেকে পরিবার ও দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তার ব্যবহৃত হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরটিও বন্ধ ছিল। পরে পরিবারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যোগাযোগ করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে থেকে দিল্লিতে বাংলাদেশ দূতাবাস ও কলকাতায় উপদূতাবাসে যোগাযোগ করে খোঁজ নিতে বলা হয়।

বুধবার কলকাতা পুলিশ জানায়, দিল্লি ও কলকাতা দূতাবাসের কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার পরই আনোয়ারুল আজীমের খোঁজে তৎপরতা শুরু করে তারা। কলকাতায় এসে এমপি আনোয়ারুল আজীম তার কথিত বন্ধু স্বর্ণ ব্যবসায়ী গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে উঠেছিলেন। ১৮ মে গোপাল স্থানীয় বরাহনগর থানায় আজিমের বিষয়ে ‘নিখোঁজ’ দাবি করে জিডি করেন। বুধবার সকালে গোপাল বিশ্বাস স্থানীয় গণমাধ্যমকে জানান, এমপি আজিমকে হত্যা করা হয়েছে বলে কলকাতা পুলিশ তাকে জানিয়েছে।

শেয়ার দিয়ে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *