শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বিভিন্ন অসম চুক্তির বিষয় সামনে আসছে। বিভিন্ন মহল থেকে এসব চুক্তি বাতিল কিংবা পর্যালোচনার দাবি উঠছে। এসব চুক্তির মধ্যে হাসিনার আমলে ভারতীয় ধনকুবের গৌতম আদানির সঙ্গে বিদ্যুৎ চুক্তির বিষয়টি অন্যতম। কোনো ধরনের দরপত্র ছাড়াই আদানি পাওয়ার লিমিটেডের সঙ্গে ২৫ বছরের জন্য অতিরিক্ত দামে বিদ্যুৎ সরবরাহের চুক্তি করে আওয়ামী লীগ সরকার। এবার এই কোম্পানির বিরুদ্ধে চুক্তি ভঙ্গের অভিযোগ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এমনকি এই চুক্তির বিষয়টি পর্যালোচনার দাবিও তুলেছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার।
আজ বৃহস্পতিবার (১৯ ডিসেম্বর) এক বিশেষ প্রতিবেদনে প্রথমবারের মতো এসব তথ্য জানিয়েছে রয়টার্স। বার্তা সংস্থাটির খবর অনুযায়ী, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের অভিযোগ, আদানি পাওয়ার চুক্তি ভঙ্গ করেছে। ভারত সরকারের কাছ থেকে কর অব্যাহতি সুবিধা বাংলাদেশকে প্রদান করেনি আদনির ঝাড়খণ্ডের গড্ডার বিদ্যুৎকেন্দ্র। এই সংক্রান্ত নথিপত্র পর্যালোচনা করে এই তথ্য জানিয়েছে রয়টার্স।
২০০ কোটি ডলার ব্যয়ে ভারতের ঝাড়খন্ডে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করে আদানি পাওয়ার। ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদিত সব বিদ্যুৎ বাংলাদেশে সরবরাহ করার চুক্তি রয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে ২৫ বছরের জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে বিদ্যুৎ সরবরাহের এই চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল কোম্পানিটি। সেই মতে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি দামে এতদিন বিদ্যুৎ সরবরাহ করে আসছিল গড্ডায় অবস্থিত ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি।
তবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তারা এই চুক্তি পুনঃআলোচনা করবে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোনো টেন্ডার ছাড়াই এই চুক্তি অনুমোদন দিয়েছিলেন। চুক্তিটি বাংলাদেশের অন্যান্য কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর তুলনায় অনেক বেশি ব্যয়বহুল। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ সংস্থার নথি ও উভয় পক্ষের মধ্যে আদান-প্রদানকৃত চিঠি এবং ছয়জন বাংলাদেশি কর্মকর্তার সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে রয়টার্স এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।
২০২৩ সালের জুলাই মাস থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে আদানি পাওয়ার। এখনো বাংলাদেশের কাছে তাদের কয়েক’শ মিলিয়ন ডলার বকেয়া রয়েছে। এ নিয়ে বিরোধের জেরে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। গত নভেম্বর মাসে আদানি পাওয়ার থেকে বিদ্যুৎ আসা প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বা ৩৩ শতাংশ কমেছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান রয়টার্সকে জানান, বর্তমানে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন সক্ষমতা দিয়ে আদানি সরবরাহ ছাড়াই সামাল দিতে পারবে। যদিও দেশের সব বিদ্যুৎকেন্দ্র কার্যকর অবস্থায় নেই।
তবে বাংলাদেশে আদানি পাওয়ারের কোনো অনিয়মের অভিযোগ করা হয়নি। রয়টার্সের প্রশ্নের জবাবে কোম্পানির একজন মুখপাত্র বলেন, তারা সব চুক্তির শর্ত পূরণ করেছেন এবং ঢাকা চুক্তি পুনরায় পর্যালোচনা করছে এমন কোনো ইঙ্গিত তারা পায়নি। কোম্পানিটি কর সুবিধা এবং বাংলাদেশের উত্থাপিত অন্যান্য বিষয় নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। সূত্র চ্যানেল ২৪
কর জালিয়াতি
কোম্পানিটি জানিয়েছে, বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তিটি ভারতের পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য পূরণে সহায়ক হয়েছে। ২০১৯ সালে বিদ্যুৎকেন্দ্রটিকে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করে দিল্লি। এটি আয়কর ও অন্যান্য করের ক্ষেত্রে ছাড়সহ বিভিন্ন সুবিধা উপভোগ করে।
২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর আদানি পাওয়ার ও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) এর মধ্যে স্বাক্ষরিত বাস্তবায়ন চুক্তি অনুযায়ী, বিদ্যুৎ সরবরাহকারী কোম্পানিটি দ্রুত বাংলাদেশের কাছে কেন্দ্রটির কর স্ট্যাটাসের পরিবর্তনের তথ্য জানাতে এবং ভারতের সরকারের দেয়া কর অব্যাহতির সুবিধা হস্তান্তর করতে বাধ্য।
কিন্তু আদানি পাওয়ার এটি করেনি। বিপিডিবি থেকে পাঠানো দুটি চিঠি থেকে এই তথ্য জানা যায়। এদের একটি ২০২৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর এবং অন্যটি ২২ অক্টোবর পাঠানো হয়। ওই চিঠিতে এই করের অর্থ হস্তান্তরের জন্য তাগিদ দেয়া হয়।
চুক্তি ও চিঠিগুলো জনসাধারণের জন্য প্রকাশ করা হয়নি। তবে রয়টার্স সেগুলো দেখেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিপিডিবির দুই কর্মকর্তা বলেছেন, আদানি পাওয়ারের কাছ থেকে কোনো উত্তর পাননি তারা।
বিপিডিবি হিসাব অনুযায়ী, কর সুবিধা হস্তান্তর করা হলে বিদ্যুতের প্রতি ইউনিটে প্রায় ০ দশমিক ৩৫ সেন্ট সাশ্রয় হতো। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ক্রয়ের একটি অপ্রকাশিত সংক্ষিপ্তসার অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ৩০ জুন শেষ হওয়া অর্থবছরে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ৮ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ইউনিট বিদ্যুৎ সরবরাহ করেছে। এতে প্রায় ২৮.৬ মিলিয়ন ডলার সাশ্রয়ের সম্ভাবনা রয়েছে।
বিদ্যুৎ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান জানান, এই বিষয়টি ভবিষ্যতে আদানি পাওয়ারের সঙ্গে আলোচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হবে।