সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২৪

জুলাইয়ে শুরু হওয়া ছাত্র আন্দোলন গণ-আন্দোলনে রূপ নিলে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার কারফিউ জারি করে ইন্টারনেট শাটডাউনের মাধ্যমে দেশকে পুরো বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। এর জেরে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের পোশাক খাত। এ কারণে আগস্ট মাসের বেতন সঠিক সময়ে দেয়া নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ীরা।

ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনের নামে জুলাই মাসের শেষ দিকে কারফিউ জারির কারণে প্রায় এক সপ্তাহ পোশাক কারখানাগুলোতে বন্ধ থাকে উৎপাদন। পাশাপাশি বন্দর বন্ধ হয়ে পড়ায় স্থবির হয়ে পড়ে পণ্য শিপমেন্ট ও কাঁচামাল আমদানি। বন্ধ ছিল ইন্টারনেটও। এ সময় অনেক বিদেশি বায়ার তাদের রফতানিকারকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হওয়ায় বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেন। অর্ডারগুলো চলে যেতে শুরু করে বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী অন্যান্য দেশে।

অবশ্য ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর দেশের পরিস্থিতি স্থিতিশীল হতে শুরু করলে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে দেশের তৈরি পোশাক খাতেও। তবে এর মধ্যেই আবার নোয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রামসহ দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ভয়াবহ বন্যার প্রভাব পড়ে সামগ্রিক পোশাক খাতের ওপর। বিশেষ করে বন্যায় দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন হিসেবে পরিচিত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক আক্রান্ত হওয়ায় এর প্রভাব পড়ে শিপমেন্টসহ পণ্য পরিবহনের ওপর। বিজিএমইএর দেয়া তথ্যমতে সব মিলিয়ে জুলাই ও আগস্ট মাসে উৎপাদন ব্যাহত হয় ১৬ দিন। উৎপাদন বন্ধ থাকা এবং পণ্য সময়মতো শিপমেন্ট করতে না পারার কারণে অনেক কারখানা মালিকই সময়মতো পেমেন্ট পাননি বলে জানিয়েছেন পোশাক রফতানিকারকরা। পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যাংক, বিশেষ করে এস আলম গ্রুপের খপ্পরে পড়া ব্যাংকগুলোতে এলসি খুলতে না পারার অভিযোগ জানিয়েছেন তারা।

এসবের জেরে পোশাক শ্রমিকদের আগস্ট মাসের বেতন দেয়ার ব্যাপারেও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এতে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে দেশের পোশাক কারখানা অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে শ্রমিক অসন্তোষ শুরু হতে পারে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তরফে এমন তথ্য পাওয়ার কথাও জানিয়েছেন ব্যবসায়ী নেতারা।

সব মিলিয়ে এ মুহূর্তে দেশের পোশাক খাত ব্যাপক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি বলে জানিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে জরুরি সহায়তা হিসেবে সহজ শর্তে প্রণোদনা সহায়তা এবং ব্যাংকের এলসি সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারের প্রতি জরুরি ভিত্তিতে আহ্বান জানিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো।

এ পরিস্থিতিতে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের নবনিযুক্ত গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে দেখা করেন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ নেতারা। তারা দ্রুত সরকারের কাছে সহজ শর্তে প্রণোদনা দাবি করার পাশাপাশি ব্যাংকে এলসি খোলা নিয়ে জটিলতা অবসানে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতি আহ্বান জানান। বিজিএমইএ সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম ও বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেমের নেতৃত্বে এই প্রতিনিধি দলে আরও ছিলেন বিজিএমইএর সিনিয়র সহ-সভাপতি আব্দুল্লাহ হিল রাকিব, সহ-সভাপতি রকিবুল আলম চৌধুরী, পরিচালক মোহাম্মদ সোহেল সাদাত, পরিচালক মেসবাহ উদ্দিন খান ও পরিচালক মো. রেজাউল আলম (মিরু)।

এ ব্যাপারে বিজিএমইএ সহ-সভাপতি ও এইচকেসি অ্যাপারেলস লি. এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক রকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের প্রতি আহ্বান জানিয়েছি যেসব ব্যাংকে আমাদের এলসি খুলতে সমস্যা হচ্ছে, সে সমস্যা যেন সমাধান হয়। বিশেষ করে এস আলম সংশ্লিষ্ট পাঁচটি ব্যাংকে এলসি খুলতে সমস্যা হচ্ছে, সেটা যেন করা যায় এ ব্যাপারে আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরকে বলেছি।’

তিনি বলেন, পাশাপাশি আমরা প্রণোদনার ব্যাপারে সরকারের কাছে আহ্বান জানিয়েছি। ১২ মাসের কিস্তিতে ন্যূনতম সুদে যেন এই প্রণোদনা দেয়া হয় সে ব্যাপারে আমরা অনুরোধ জানিয়েছি। কারণ গত দেড় মাস ধরেই আমাদের উৎপাদন নানা সময় বিঘ্নিত হয়েছে। মূলত আগস্ট মাসের বেতন দেয়ার জন্যই এই প্রণোদনা আমরা চেয়েছি। কারণ সাম্প্রতিক সময়ে উৎপাদন বিঘ্নিত হওয়ায় অনেক কারখানা মালিকই সমস্যায় রয়েছেন।

এদিকে উৎপাদন বিঘ্নিত হওয়ায় কারখানা মালিকরা যেসব সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন তা সমাধানের ব্যাপারে বিজিএমইএ’র তরফে নানা ধরনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যেই বায়ার্স ফোরামের সঙ্গে কথা বলেছি। পাশাপাশি নতুন যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে, এই সরকারের প্রতি আমরা আস্থাশীল। তার আন্তর্জাতিক ইমেজ রয়েছে। তাই আমরা আশা করছি যে অর্ডারগুলো আমরা হারিয়েছি তা আমরা অচিরেই ফেরত পাব।’

অপরদিকে বিজিএমইএ’র পরিচালক ও গ্যালপেক্স লি. এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক রেজাউল আলম মীরু বলেন, ‘আমরা বিজিএমইএ’র পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে দেখা করেছিলাম মূলত আমাদের কয়েকটি দাবি নিয়ে, বিশেষ করে আমরা সাম্প্রতিক সময়ে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। জুলাই ও আগস্ট মাস মিলিয়ে আমাদের মোট ১৬ দিন কাজ হয়নি। এজন্য আমাদের রফতানিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এজন্য আমরা সরকারের কাছে সহজ শর্তে ঋণ চেয়েছি। তাছাড়া গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী আগস্ট মাসের বেতন যদি ঠিকভাবে না দেয়া যায় তবে শ্রমিক অসন্তোষ শুরু হতে পারে। যেহেতু এমন আশঙ্কা রয়েছে, তার ওপর অনেক কারখানা মালিকেরই সক্ষমতা নেই, তারা শিপমেন্ট করতে পারেননি, অনেকের পণ্য পড়ে আছে, অনেকের পেমেন্ট আসেনি। এজন্য আমরা বারো মাসের জন্য সহজ শর্তে ঋণ সহায়তা চেয়েছি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে। তিনি আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন। ইনশাল্লাহ রোববারের মধ্যে আমরা পেয়ে যাব।’

জুলাই আগস্ট মাসে কয়েকদিন উৎপাদন বিঘ্নিত হওয়ার জেরে সমস্যায় পড়েছেন অনেক কারখানা মালিক ও রফতানিকারক। তাদের সমস্যা সমাধানে বিজিএমইএ’র উদ্যোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমাদের এখন মূল লক্ষ্য শ্রমিকদের এই মাসের বেতনটা নিশ্চিত করা। যদি আমরা সময় মতো সঠিকভাবে বেতনটা দিতে পারি, তবে আস্তে আস্তে আমরা সামনের মাসগুলোতে যে ব্যাকলগগুলো তৈরি হয়েছে তা সমাধান করে এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারব। এ পরিস্থিতিতে সেপ্টেম্বর মাসে সঠিক সময়ে বেতন দিতে পারাটাই আমাদের জন্য প্রথম প্রয়োরিটি। কারণ আমাদের শ্রমিকরা একটা নির্দিষ্ট সময়ে বেতন পেতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। তারা যদি সময় মতো বেতনটা না পান তবে তাদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হতে পারে। যা বর্তমান পরিস্থিতিতে কাম্য নয়। কারণ বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন তরফে ইন্ধন তো রয়েছেই। এর আগে কোভিডের সময় আমরা ঋণের কিস্তি দেয়ার ব্যাপারে ছয় মাসের একটা সময় পেতাম, এখন সেটা তিন মাস করা হয়েছে। এখন যেহেতু সংকটময় সময়, তাই এই পরিস্থিতি উত্তরণে আমরা সেটা আবার ছয় মাসে পুনর্বহালের দাবি জানিয়েছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘পাশাপাশি আমাদের কারখানাগুলোর ইউটিলিটি বিলগুলো আমরা সময় মতোই পরিশোধ করার চেষ্টা করি। তবে যদি ক্ষেত্র বিশেষে যদি বিল বকেয়া পড়ে, তবে যেন ছয় মাস পর্যন্ত আমাদের কারখানার সংযোগ বিচ্ছিন্ন না হয়, আমরা সেই অনুরোধ করেছি। সব মিলিয়ে এই খাতকে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরিয়ে আনতে আমরা সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়েছি, যেন আমাদের সময় দেয়া হয়।’

বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে অধীনে দেশের পোশাক খাতের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আশা করি দুই এক মাসের মধ্যেই আমাদের পোশাক খাত পূর্ণ গতিতে ছুটতে শুরু করবে। আন্তর্জাতিক বাজারেও আমাদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।’

অপরদিকে পোশাক খাতের অপর গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন বা বিকেএমইএ’র সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমাদের ব্যাংকে এলসি খোলা নিয়ে সমস্যা পোহাতে হচ্ছে। এমনকি আমি নিজেও এলসি করতে পারছি না ১৬ দিন ধরে। এখন যদি আমাদের রফতানির লিড টাইমের ১৬ দিন যদি ব্যাংকেই এলসি না খুলতে পারার কারণে অপচয় হয়, তবে পরবর্তীতে শিপমেন্ট নিয়ে যে জটিলতা তৈরি হবে তার দায় কে নেবে। আমরা শিপমেন্টটা কীভাবে করব। আমরা যদি শিপমেন্ট সময়ে পিছিয়ে পড়ি তাহলে আমাদের এয়ারশিপমেন্টে যেতে হবে, যেখানে খরচ অনেক বেশি। অথবা ক্রেতারা আমাদের কাছে ডিসকাউন্ট চাইবে। এর বোঝা শেষ পর্যন্ত চাপবে রফতানিকারকদের ঘাড়ে। অথচ সমস্যা তৈরি করছে ব্যাংকগুলো। তাই দায় তাদেরই নিতে হবে। এই সমস্যাগুলো সমাধানে আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতি আহ্বান জানিয়েছি।’

এর আগে আন্দোলন দমনের নামে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের কারফিউ জারি ও ইন্টারনেট শাটডাউনের কারণে পোশাক কারখানার মালিক ও রফতানিকারকরা ভুক্তভোগী হয়েছেন উল্লেখ করে বিকেএমইএ সভাপতি বলেন, ‘এখন যদি ব্যাংক ও কাস্টমস এ আমাদের ভোগান্তি না পোহাতে হয়, তবে আগামী অল্পদিনের মধ্যেই উৎপাদনের পরিবেশ পুরোদমে স্বাভাবিক হয়ে আসবে।’

এনবিআর ও কাস্টমসের নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান আবদুর রহমানের ওপর আস্থা প্রকাশ করে বিকেএমইএ সভাপতি বলেন, ‘আমরা ব্যবসায়ীরা ইতোমধ্যেই এনবিআর এর চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করে, তাদের আমরা আমাদের সমস্যার কথা জানিয়েছি। তিনি অত্যন্ত সজ্জন ও দক্ষ একজন মানুষ। আমাদের সমস্যাগুলো আন্তরিকতার সঙ্গে শুনেছেন এবং সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন। সব মিলিয়ে নতুন এই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আমাদের জ্বালানি, ব্যাংকিং এবং কাস্টমসের সমস্যা দূর করার জন্য আহ্বান জানিয়েছি।’ সূত্র সময় টিভি

শেয়ার দিয়ে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *