ডিসেম্বর ২৭, ২০২৪

বিজ প্রতিবেদক

এবার আইপিডিসি ফাইন্যান্সের শেয়ার নিয়ে কারসাজির অভিযোগে আবারও সমবায় অধিদপ্তরের ডেপুটি রেজিস্ট্রার মো. আবুল খায়ের হিরু এবং তার সহযোগীদের দেড় কোটি টাকা জরিমানা করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

সম্প্রতি নিয়মিত কমিশন সভায় আবুল খায়ের হিরু এবং তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় কমিশন জরিমানা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

পুঁজিবাজারে এক বছরের বেশি সময় ধরে গুঞ্জন ছিল— আর্থিক খাতে তালিকাভুক্ত কোম্পানি আইপিডিসি ফাইন্যান্সের শেয়ার নিয়ে কারসাজি চলছে। কোম্পানিটির ব্যবসা ও আর্থিক অবস্থার উন্নতির কারণে নয়, বরং কারসাজির মাধ্যমে শেয়ারের দাম বেড়েছে। অবশেষে তদন্ত সাপেক্ষে কোম্পানিটির শেয়ার কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় এনেছে বিএসইসি।

বিএসইসির সিদ্ধান্তে জানানো হয়, আইপিডিসি ফাইন্যান্সের শেয়ার লেনদেনের মাধ্যমে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিনেন্স, ১৯৬৯ এর সেকশন ১৭ এর (ই)(৫)(৩)(২) ভঙ্গের জন্য মো. আবুল খায়ের এবং তার সহযোগীদের মোট ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ বিষয়ে বিএসইসির এনফোর্সমেন্ট বিভাগ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।

এর আগে চলতি বছরের আগস্টে বিডিকম অনলাইন, ওয়ান ব্যাংক, ফরচুন শু, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক, এশিয়া ইন্স্যুরেন্স, গ্রিন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স ও ঢাকা ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার নিয়ে কারসাজির অভিযোগে আবুল খায়ের হিরুসহ তার সহযোগীদের (স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসান, বাবা আবুল কালাম মাতবর, বোন কনিকা আফরোজ, শ্যালক কাজী ফরিদ হাসান, তার কোম্পানি মোনার্ক হোল্ডিং, ডিআইটি কো-অপারেটিভ এবং দেশ আইডিয়াল ট্রাস্ট) মোট ১০ কোটি ৮৯ লাখ টাকা জরিমানা করে বিএসইসি। আবুল খায়ের সমবায় অধিদপ্তরের ডেপুটি রেজিস্ট্রার। ৩১তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি এ পদে যোগ দেন।

বিএসইসি সূত্রে জানা গেছে, অধিক পরিমাণ শেয়ার কেনাবেচার মাধ্যমে মো. আবুল খায়ের এবং তার সহযোগীরা একে অপরের সহযোগিতায় আইপিডিসি ফাইন্যান্সের শেয়ার দাম কৃত্রিমভাবে বাড়িয়েছেন। এ বিষয়টি তদন্তে প্রমাণিত হওয়ায় সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিন্যান্স, ১৯৬৯ এর সেকশন ২২ এবং সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন আইন, ১৯৯৩ এর ১৮ ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে এ জরিমানা ধার্য করেছে কমিশন। তবে, আইপিডিসি ফাইন্যান্সের শেয়ার কারসাজির মাধ্যমে আবুল খায়ের এবং তার সহযোগীরা কত কোটি টাকা মুনাফা করেছেন, তা এখনও জানা যায়নি।

গত দুই বছরের মধ্যে আইপিডিসি ফাইন্যান্সের শেয়ারের দামে সর্বোচ্চ অবস্থানে উঠে এসেছে। বিশেষ করে, ২০২১ সালের ১২ এপ্রিল কোম্পানিটির শেয়ারের দাম দুই বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমে আসে। তবে, এর পর থেকেই ধারাবাহিকভাবে বাড়তে শুরু করে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম। এ সময়ের মধ্যে পুঁজিবাজারে ভালো মৌল ভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানির শেয়ারের দাম কমলে আইপিডিসির শেয়ার কারসাজির কারণে সর্বোচ্চ অবস্থানে আছে।

যেকোনো কোম্পানির শেয়ারদর কোম্পানটির ব্যবসা এবং আর্থিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে বাড়ে। কিন্তু, আইপিডিসি ফাইন্যান্সেরর শেয়ারের দাম যেভাবে বেড়েছে, তা ব্যবসা ও মুনাফার তুলনায় অনেক বেশি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

আইপিডিসি ফাইন্যান্সেরর বাজারচিত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে আইপিডিসি ফাইন্যান্সেরর শেয়ারের দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৩০ টাকা ৫০ পয়সা। এর পর শেয়ারের দর কমে যায়। আবার ২০২১ সালের ৩ জানুয়ারি কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ছিল ২৭.৬০ টাকা। তবে, ১২ এপ্রিল শেয়ারটির দাম কমে দাঁড়ায় ২২.২০ টাকায়। এর পর থেকেই কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বাড়তে থাকে। ওই বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর কোম্পানিটির শেয়ারের দাম সর্বোচ্চ বেড়ে দাঁড়ায় ৪৮.৬০ টাকায়। তবে, ২০২২ সালের ২ জানুয়ারি কোম্পানিটির শেয়ারের দাম কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৩৯.২০ টাকায়। ৫ মে পর্যন্ত কোম্পানিটির শেয়ারের দাম সর্বোচ্চ বেড়ে দাঁড়ায় ৫৯ টাকায়। চলতি বছরের ২৫ আগস্ট আইপিডিসি ফাইন্যান্সের শেয়ার ফের সর্বোচ্চ বেড়ে ৭৬.২০ টাকায় অবস্থান করে ইতিহাস সৃষ্টি করে। চলতি বছরের মে-জুন মাসে কোম্পানিটির শেয়ার নিয়ে শুরু হয় বড় ধরনের কারসাজি। কোম্পানিটির শেয়ারের কারসাজিতে জড়িতদের মধ্যে হিরুর নাম ছিল বিনিয়োগকারীদের মুখে মুখে। ফলে, আইপিডিসি ফাইন্যান্সের শেয়ারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ার পেছনে কোনো কারসাজি আছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে বিএসইসির কাছে বিভিন্নভাবে অনুরোধ জানান বিনিয়োগকারীসহ সংশ্লিষ্টরা। সার্বিক দিক বিবেচনা করে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ার কারণ খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নেয় বিএসইসি। তদন্ত কার্যক্রম সম্পন্নের পর অবশেষে আইপিডিসি ফাইন্যান্সেরর শেয়ারের দাম কৃত্রিমভাবে বাড়ানোর নেপথ্যে থাকা কারসাজিকারীদের নাম বেড়িয়ে এসেছে।

এদিকে, আইপিডিসি ফাইন্যান্সের গত দুই বছর ও সর্বশেষ আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে দেখা যায়, ২০২০ সালে কোম্পানিটির ব্যবসায় মুনাফা হয়েছে ৭০ কোটি ৫৫ লাখ ৬০ হাজার টাকা। সে সময় কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি মুনাফা (ইপিএস) ছিল ১.৯০ টাকা। এর পর ২০২১ সালে কোম্পানিটির ব্যবসায় মুনাফা হয় ৮৮ কোটি ১০ লাখ ৬০ হাজার টাকা। সে সময় কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি মুনাফা ছিল ২.৩৭ টাকা। ২০২০ ও ২০২১ সালে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য (এনএভিপিএস) ছিল যথাক্রমে ১৬.৩৪ টাকা এবং ১৭.১২ টাকা।

২০২০ সাল ৩০ ডিসেম্বর কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ছিল ২৭.৬০ টাকা এবং ২০২১ সালের ৩০ ডিসেম্বর কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ছিল ৩৮.৬০ টাকা। সে হিসাবে কোম্পানির শেয়ারের দাম ইপিএস ও এনএভি তুলনায় স্বাভাবিক ছিল বলে মনে করেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

কিন্তু, কোম্পানিটির সর্বশেষ প্রকাশিত অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে দেখা গেছে, অর্ধবার্ষিকে (জানুয়ারি-জুন, ২০২২) কোম্পানির ইপিএস হয়েছে ১.১৯ টাকা এবং এনএভি দাঁড়িয়েছে ১৭.১১ টাকা।

রোববার (১৬ অক্টোবর) আইপিডিসি ফাইন্যান্সের শেয়ার সর্বশেষ ৫৭.৬০ টাকায় লেনদেন হয়েছে।

শেয়ার দিয়ে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন...