এপ্রিল ২৫, ২০২৪

৯৩৯ কোটি টাকা খেলাপীর দায়ে চট্টগ্রামভিত্তিক শীর্ষস্থানীয় জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। গত ৩ মে বন্দরনগরীর ন্যাশনাল ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার প্রিন্সিপাল অফিসার সুজা উদ্দিন আল মামুন অর্থঋণ মামলাটি (নং-২১৫) দায়ের করেছেন।

মামলার আসামিরা হলেন ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের চেয়ারম্যান মো. সাইফুল ইসলাম, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন সোহেল হাসান, পরিচালক মো. শাখাওয়াত হোসেন, আবু মো. ফজলে রশীদ, মনজুর মোরশেদ চৌধুরী, সাঈদুল ইসলাম, এ কে এম রেজাউর রহমান, আরিফুর রহমান খান, শাহ আলম, মোহাম্মদ আবদুল মোবিন ও ক্যাপ্টেন এবিএম ফজলে রাব্বি।

মামলার নথি সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালের ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড কর্তৃপক্ষ ন্যাশনাল ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখায় ৪০২ কোটি ৫০ লাখ টাকার ঋণ আবেদন করে। এর পরপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ২৩ মার্চ প্রধান কার্যালয়ের মঞ্জুরীপত্র ও ২৪ মার্চ শাখা অফিসের মঞ্জুরীপত্রের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটিকে টার্ম লোন খাতে ১৫০ কোটি টাকা, লোন (জি) খাতে ৫০ কোটি টাকা এবং ক্যাশ ক্রেডিট (হাইপো) খাতে ৬০ কোটি টাকাসহ মোট ২৬০ কোটি ঋণ সুবিধা মঞ্জুর করা হয়।

ঋণ মঞ্জুর হওয়ার দিনই ওয়েস্টার্ন মেরিন কর্তৃপক্ষ ক্যাশ ক্রেডিট খাতের ঋণ ৬০ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ১১০ কোটি, নতুন করে ব্যাংক গ্যারান্টি খাতে ৭৫ কোটি, এলসি খাতে ৪৫ কোটি- মোট ১৫০ কোটি টাকা ঋণ সুবিধার জন্য ব্যাংকে আবেদন করে।

ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ১৯ মে এলসি খাতে ৪৫ কোটি, ব্যাংক গ্যারান্টি খাতে ৭৬ কোটি ৬৩ লাখ টাকা মঞ্জুর করে এবং ক্যাশ ক্রেডিট (হাইপো) খাতের ঋণ ৬০ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০৫ কোটি বাড়িয়ে মোট ১৬৬ কোটি ৬৩ লাখ টাকার ঋণ সুবিধা মঞ্জুর করে।

ঋণ সুবিধা চলাকালে বিবাদীরা নতুনভাবে টার্ম লোন খাতে ৫০ কোটি টাকা ও আগের মঞ্জুরীকৃত টার্ম লোন ১৫০ কোটি টাকা এবং আগের মঞ্জুরীকৃত লোন (জি) ৫০ কোটি টাকার সুদের হার ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৪ শতাংশ করার আবেদন করলে ব্যাংক ২০১৫ সালের ১৫ জানুয়ারি টার্ম লোন ২৫ কোটি মঞ্জুর ও সুদের হার ১ শতাংশ কমিয়ে দেয়। এজন্য মর্টগেজ হিসাবে প্রতিষ্ঠানটির জমি জমা দেয়।

এভাবে প্রতিষ্ঠানটির কাছে ন্যাশনাল ব্যাংকের ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫২৮ কোটি ৬৮ লাখ ৬৮ লাখ ৭৬ হাজার ৬৫০ টাকা। এর সঙ্গে ৪০৯ কোটি ৮০ লাখ ১৬ হাজার ৭৪৪ টাকা সুদ, ২৪ লাখ ৫৯০ টাকা অন্যান্য চার্জসহ ওয়েস্টার্ন মেরিন শীপইয়ার্ডের কাছে ন্যাশনাল ব্যাংকের মোট পাওনা ৯৩৮ কোটি ৭২ লাখ ৯৩ হাজার ৯৮৫ টাকা। এর মধ্যে ব্যাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিয়ে ঋণ কয়েক দফায় পুনঃতফসিল করলেও ব্যাংকের দায় পরিশোধ করেনি ওয়েস্টার্ন মেরিন।

ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানায়, করোনাকালে বিআরপিডি সার্কুলার ১৩, ১৯, ৫১, ৫৩, ৩ অনুসারে ঋণের টাকা পরিশোধের সময় বাড়ানো হলেও ওয়েস্টার্ন মেরিন কর্তৃপক্ষ ঋণ পরিশোধ না করায় ঋণখেলাপী হিসাবে গণ্য হয়। এজন্য ২০২২ সালের ১৩ নভেম্বর ঋণ পরিশোধে লিগ্যাল নোটিশ দিলেও কোনো টাকা পরিশোধ করেনি। এজন্য অর্থঋণ আদালত আইন ২০০৩ এর ১২(৩) ধারায় চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি বন্ধকী সম্পত্তি নিলামে বিক্রির জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করলেও কেউই নিলামে অংশ নেয়নি। এ কারণে বাধ্য হয়ে অনাদায়ী ঋণ আদায়ে অর্থঋণ আদালতে মামলা দায়ের করেছে বলে জানিয়েছেন ন্যাশনাল ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।

ন্যাশনাল ব্যাংকের আইন কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোনায়েম মামলার বিষয়টি স্বীকার করলেও বিস্তারিত কোনো মন্তব্য করতে রাজী হননি। ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের বিরুদ্ধে মামলা সংক্রান্ত বিষয়ে ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে যোগাযোগের অনুরোধ করেন তিনি।

চট্টগ্রামভিত্তিক দেশের প্রথম সারির রফতানিমুখী জাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড। ২০০০ সালে যাত্রার পর প্রায় দেড় দশক ধরে বিভিন্ন ক্যাটাগরির জাহাজ নির্মাণ ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে জাহাজ রফতানির মাধ্যমে নিজেদের এ খাতের বড় প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। এতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও উদারহস্তে ঋণ দিয়েছে কোম্পানিটিকে। পুঁজিবাজার থেকেও ২০১৪ সালে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে শেয়ারপ্রতি ২৫ টাকা প্রিমিয়ামে ১৫৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা সংগ্রহ করে। তবে অনিয়ম, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, অদূরদর্শী পরিকল্পনায় দেশের অন্তত ১০ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে ওয়েস্টার্ন মেরিনের খেলাপী ঋণের পরিমাণ ২ হাজার কোটি টাকারও বেশি। অর্থ সংকটের কারণে প্রতিষ্ঠানটির সব কার্যক্রম কয়েক বছর ধরে বন্ধ রয়েছে।

শেয়ার দিয়ে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *