দেশের জনগণকে বিনিয়োগ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে কাজ করে যাচ্ছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। ইতিমধ্যে বিনিয়োগ শিক্ষা পাঠ্যপুস্তকের নতুন কারিকুলামে সংযুক্ত করার বিষয়ে আশ্বাস দিয়েছে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। তবে বৈশ্বিক নানামুখী সংকটের কারণে দেশের পুঁজিবাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। ফলে পুঁজিবাজারে পুরুষ বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি নারীদের সম্পৃক্ততা অনেক কমেছে। গত ৭ বছরের পুঁজিবাজারে নারী বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাবের সংখ্যা ৪৭.২৫ শতাংশ কমেছে।সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিডিবিএল) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এদিকে, বৈশ্বয়িক মহামারি করোনা সংক্রামণের মধ্যেও নিজেদের আয় বাড়াতে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে অনেক নারী পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেছেন। এক্ষেত্রে সে দেশের নারীরা মিউচ্যুয়াল ফান্ডকে বিনিয়োগের আদর্শ ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তবে করোনার মধ্যেও ভারতের নারী বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ যেভাবে বাড়ছে, ঠিক উল্টো চিত্র লক্ষ্য করা গেছে দেশের পুঁজিবাজারে। এখানে নারী বিনিয়োগকারীরা বেশ পিছিয়ে রয়েছেন।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুঁজিবাজারে ধারাবাহিক মন্দা পরিস্থিতি নারীদের এ খাতে বিনিয়োগ ভীতি বাড়ছে। দেশের পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা বজায় না থাকায়, নারীরা তাদের সঞ্চয় এখানে বিনিযোগে ঝুঁকি নিতে চান না। এছাড়া, বিনিয়োগ শিক্ষার বিষয়ে তুলনামূলক প্রচার-প্রচারণা কম থাকা পুঁজিবাজারে নারীরা পিছিয়ে রয়েছেন। এ বিষয়টির ওপর পুঁজিবাজারের স্টেকহোল্ডাররাও খুব বেশি গুরুত্ব দেন না। তাই এ সেক্টরে নারীদের অনীহা বেড়েই চলেছে।
এক্ষেত্রে, নারীদের গচ্ছিত সঞ্চয় বাজারে বিনিয়োগ হিসেবে আনতে হলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ, মার্চেন্ট ব্যাংক, ব্রোকারেজ হাউজসহ সকল স্টেকহোল্ডারা এ বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার পাশাপাশি বছরজুড়ে নারীদের বিনিয়োগ শিক্ষার বিষয়ে ধারাবাহিক প্রশিক্ষণ বা কর্মশালা আয়োজনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। এছাড়া, প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের মাধ্যমে (আইপিও) মাধ্যমে পুঁজিবাজারে নারীরা যে ঝুঁকিমুক্ত বিনিয়োগ করতে বিষয়টি প্রচারের মাধ্যমে তুলে ধরতে হবে। একইসঙ্গে সেকেন্ডারি মার্কেটে বন্ড ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ- এ ধারণা নারীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। এতে নারীরা বিনিয়োগে উৎসাহী হবেন।
সিডিবিএল সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালে পুঁজিবাজারে নারী নিয়োগকারীর সংখ্যা ৮ লাখ ছাড়িয়ে ছিল। পরবর্তীতে ধসের পর এখন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন প্রায় ২ লাখ নারী বিনিয়োগকারী। ধীরে ধীরে পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরে আসায় বাজারে নারীদের অংশগ্রহণ কিছুটা বাড়ে, তবে তা ২০১০ সালে মতো নয়।
সিডিবিএলে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালের ২০ ডিসেম্বর দেশের পুঁজিবাজারে নারী বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাবের সংখ্যা ছিল ৮ লাখ ৬৫ হাজার ২৫০টি। ২০১৭ সালের ৮ মার্চ পর্যন্ত নারী বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব কমে দাঁড়ায় ৭ লাখ ৯৬ হাজার ৩৯২টিতে। ২০১৮ সালের ৮ মার্চ পর্যন্ত নারী বিও হিসাব কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৭ লাখ ৩৩ হাজার ৫৫৮টিতে। তবে ২০১৯ সালের ৭ মার্চ পর্যন্ত এ বিও হিসাবের সংখ্যা কিছুটা বেড়ে দাঁড়ায় ৭ লাখ ৫৩ হাজার ৫৯২টিতে। আর তারপর থেকেই কমতে থাকে নারী বিও হিসাবের সংখ্যা।
২০২০ সালের ৮ মার্চ নারী বিও হিসাবের সংখ্যা ছিল ৬ লাখ ৮৪ হাজার ৯১৮টি, ২০২১ সালের ৮ মার্চ নারী বিও হিসাবের সংখ্যা ছিল ৬ লাখ ৮৭ হাজার ৯০টি, ২০২২ সালের ৮ মার্চ নারী বিও হিসাবের সংখ্যা ছিল ৫ লাখ ১৪ হাজার ৪৪১টিতে। আর চলতি বছরের ৭ মার্চ (মঙ্গলবার) পর্যন্ত নারী বিও হিসাবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৫৬ হাজার ৪৪৬টিতে। সে হিসাবে গত ৭ বছরের দেশের পুঁজিবাজারে নারী বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাবের সংখ্যা কমেছে ৪ লাখ ৮ হাজার ৮০৪টি বা ৪৭.২৫ শতাংশ।
বর্তেমানে চলতি বছরের ৭ মার্চ পর্যন্ত দেশের পুঁজিবাজারে পুরুষ ও নারীর মোট বিও হিসাব সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৬৮ হাজার ৮৩১টিতে। এর মধ্যে পুরুষ বিও হিসাবের সংখ্যা ১৩ লাখ ৯৫ হাজার ৭৮৭টি। সে হিসাবে নারী বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাবের পরিমান ২৪.৪২ শতাংশ। ফলে পুঁজিবাজারে মোট বিও হিসাবের মধ্যে এক-চতুর্থাংশই এখন নারী বিনিয়োগকারী।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ক্যাপিটাল মার্কেটের (বিআইসিএম) নির্বাহী প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ড. মাহমুদা আক্তার বলেন, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের বিষয়ে নারীদের কীভাবে প্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলা যায়, সে বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। বিআইসিএম ইতিমধ্যে নারী বিনিয়োগকারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য কিছু মডিউল তৈরি করেছে। সে মডিউল অনুযায়ী কাজ চলছে। তবে করোনা মহামারির মধ্যে আমরা নারীদের উদ্বুদ্ধ করতে ভার্চুয়ালি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করি। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতির কারণে পুঁজিবাজারে অস্থিরতা বিরাজ করায় নারী ও পুরুষ উভয় বিনিয়োগকারীর সংখ্যা কমেছে। এক্ষেত্রে আমাদের সক্ষমতা বাড়াতে আরও সহযোগিতা প্রয়োজন।