নভেম্বর ১৫, ২০২৪

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে নগদ টাকার সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। ডিসেম্বরে ব্যাংক ক্লোজিং বা ব্যাংকের বার্ষিক হিসাব-নিকাশের সময়ও ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে ভুগছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে অক্টোবর এই ৪ মাসে ব্যাংকগুলোতে আমানত প্রবাহ বেড়েছে। তারপরও ব্যাংকগুলোর গড়ে তারল্য কমেছে ১৮ হাজার কোটি টাকা। এই সংকট মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ কলমানি মার্কেট থেকে ব্যাপকভাবে ধার করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

সূত্র জানায়, মূলত চারটি কারণে ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট বেড়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, আমানত বাড়ার চেয়ে ঋণ প্রবাহ বেশি মাত্রায় বৃদ্ধি, সংকট মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নগদ টাকায় ডলার কেনায় টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আটকে যাওয়া, বিতরণ করা ঋণ আদায় না হওয়া ও খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া। এতে ব্যাংকগুলোর অর্থ আটকে রয়েছে ওইসব খাতে। ফলে ঋণ বিতরণ করতে গিয়ে টাকার জোগান দিতে সমস্যা হচ্ছে। গ্রাহকদের চাহিদা মেটাতে গিয়েও হিমশিম খাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে থাকা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর চলতি হিসাবেও ঘাটতি দেখা দিয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, জুলাইয়ে ব্যাংকগুলোতে মোট তারল্য ছিল ৪ লাখ ৩৮ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা। আগস্টে তা কমে দাঁড়ায় ৪ লাখ ৩৭ হাজার ৭৯১ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বরে আরও কমে দাঁড়ায় ৪ লাখ ২৮ হাজার ৫৮১ কোটি টাকা। অক্টোবরে আরও কমে ৪ লাখ ২১ হাজার ৭১৩ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এই ৪ মাসে তারল্য কমেছে ১৮ হাজার কোটি টাকা। এদিকে গত বছরের জুনের তুলনায় তারল্য কমেছে ২০ হাজার কোটি টাকা। গত বছরের জুনে ব্যাংকগুলোতে তারল্য ছিল ৪ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা।

চলতি অর্থবছরের প্রথম ৪ মাসে ব্যাংকগুলোতে আমানত প্রবাহ বেড়েছে প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছিল ১৯ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংক থেকে গ্রাহকদের টাকা তুলে নেওয়ার প্রবণতাও কমেছে। জুনে টাকা তুলে নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছিল ২৪ শতাংশ। অক্টোবরে তা কমে ৪ শতাংশে নেমেছে। এসব কারণে ব্যাংকে টাকার প্রবাহ বাড়ার কথা।

এছাড়া প্রতিবছর ডিসেম্বরের শেষে ব্যাংকের বার্ষিক হিসাব-নিকাশের সময় আমানত প্রবাহ বাড়ে। ব্যাংকগুলোতে অতিরিক্ত তারল্য থাকে। যে কারণে এ সময় কলমানির সুদ হার একবারে সর্বনিম্ন ১ থেকে ২ শতাংশের মধ্যে নেমে আসে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে উলটো চিত্র। টাকার সংকটে ব্যাংকগুলো কলমানি মার্কেট ধরনা দিচ্ছে। এখানে না পেলে স্বল্প ও মেয়াদি ধার করছে। এগুলোতে না পেলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ধারস্থ হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় প্রতিদিনই গড়ে ১৮ থেকে ২৬ হাজার কোটি টাকার ধার করছে। এ ধরনের ধার-দেনা ব্যাংকিং ব্যবস্থায় নিয়মিত ঘটনা হলেও এর মাত্রা যেভাবে বাড়ছে একে ভালো চোখে দেখছেন না অর্থনীতিবিদরা। তারা মনে করছেন, ব্যাংক ঋণ হিসাবে যেসব অর্থ বিতরণ করছে সেগুলো আর ফেরত আসছে না। এমন কি সুদ বাবদ অর্থও আসছে না। উলটো এগুলো খেলাপি হয়ে এর বিপরীতে প্রভিশন রাখতে গিয়ে আরও টাকা আটকে যাচ্ছে। এ কারণে ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে।

এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংকিং তারল্য সংকট এক দিনে হয়নি। দীর্ঘ সময় ধরে চলা লুটপাটের কারণে ব্যাংক থেকে যেসব অর্থ বেরিয়েছে সেগুলো ফেরত আসছে না। খেলাপি ঋণ বাড়ায় এর বিপরীতে প্রভিশন রাখতে হচ্ছে। এছাড়া চড়া মূল্যস্ফীতি ও আস্থার সংকটে অনেকে ব্যাংকে টাকা রাখছে না। একটি শ্রেণি টাকা বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে। ব্যাংকগুলোও তারল্য ব্যবস্থাপনা ভালোভাবে করতে পারছে না।

সূত্র জানায়, গত বছরের জুলাই থেকে ব্যাংকগুলোতে ডলার সংকট দেখা দেয়। বছর শেষে তা আরও বাড়ে। চলতি বছরের শুরুতে এ সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। এ সময় ব্যাংকগুলো এলসির দেনা মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার কিনে নগদ টাকায়। গত অর্থবছরের ১ হাজার ৩৫৮ কোটি ডলার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে বিক্রি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর বিপরীতে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে যায়। চলতি অর্থবছরের বুধবার পর্যন্ত প্রায় ৭০০ কোটি ডলার বিক্রি করেছে। এর বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে গেছে প্রায় ৭৭ হাজার কোটি টাকা। এসব কারণেও ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট বেড়েছে।

চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরে ব্যাংকগুলোতে আমানত প্রবাহ বেড়েছে ৯ দশমিক ৭৯ শতাংশ। এর বিপরীতে ঋণ প্রবাহ বেড়েছে ১২ দশমিক ১৯ শতাংশ। আমানতের চেয়ে ঋণ বেশি বেড়েছে ২ দশমিক ৪ শতাংশ।

শেয়ার দিয়ে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন...