অক্টোবর ৮, ২০২৪

সরকারি সিকিউরিটিজ লেনদেনকে গতিশীল করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাইমারি ডিলারদের অংশগহণে গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।

বুধবার (২ নভেম্বর) রাজধানীর একটি হোটেলে ‘সরকারি সিকিউরিটিজ এবং এক্সচেঞ্জ প্ল্যাটফর্মে ট্রেডিং সম্পর্কিত বিষয়ক’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।

বৈঠকে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই)র চেয়ারম্যান মো. ইউনুসুর রহমানের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কমিশনার ড. শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ।

এ ছাড়া, ডিএসই’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) এম. সাইফুর রহমান মজুমদার, এফসিএ বাংলাদেশ ব্যাংকের অতিরিক্ত পরিচালক এম আনোয়ার হোসেন, সিডিবিএল এর মহাব্যবস্থাপক মাইনুল হক এবং ডিএসই’র প্রোডাক্ট এন্ড মার্কেট ডেভেলপমেন্ট ডিপার্টমেন্টের প্রধান সাইদ মাহমুদ জুবায়ের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ৷

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বিএসইসি’র কমিশনার ড. শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, বর্তমান কমিশন দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই উদ্ভাবনী ও দূরদর্শী চিন্তা চেতনায় পুঁজিবাজারকে অধিকতর প্রসারিত করণের লক্ষ্যে পণ্য বৈচিত্রতা আনয়নে কাজ করছে৷ স্টক এক্সচেঞ্জে সরকারি সিকিউরিটিজ লেনদেনের ধারাবাহিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের (অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, স্টক এক্সচেঞ্জ, সিডিবিএল) সাথে বিভিন্ন সময়ে একাধিকবার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আব্দুর রউফ তালুকদার বংলাদেশ ব্যাংকে গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর সরকারি সিকিউরিটিজ লেনদেনের বিষয়টি আরো গতি পায়।

সরকারী সিকিউরিটিজ যেহেতু বিনিয়োগের একটা সুরক্ষিত মাধ্যম, তাই সবাই তাদের পোর্টফোলিওর একটা অংশ সরকারী সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করে৷ যাতে পোর্টফোলিওর একটা অংশ লস হলেও এই বিনিয়োগ সুনিশ্চিতভাবে তার কাছে থেকে যায়৷ বিশ্বের অন্যান্য দেশে ঝুঁকি বিন্যাস করণে এটা এভাবে ব্যবহৃত হলেও পূর্বে আমাদের পুঁজিবাজারে সরকারী সিকিউরিটিজ না থাকার কারণে দেশের বিনিয়োগকারীগনের বিনিয়োগের ঝুঁকি অনেক বেশী ছিল৷

তিনি আরো বলেন, “২০ দিনে মাত্র ৮টি লেনদেন হয়েছে৷ কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা গেছে চাহিদার ও যোগানের মধ্যে একটা পার্থক্য বা গ্যাপ রয়ে গিয়েছে৷ এ ক্ষেত্রে সমস্যা হল সঠিক প্রচারনার মাধ্যমে এর চাহিদা তৈরী করা হয়নি৷ যার ফলশ্রুতিতে প্রথম দিনের লেনদেনের পরেই বিও আইডি দিয়ে লেনদেন করতে হলে বিএসইসি ও ডিএসই’র অনুমোদন নিতে হবে মর্মে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। যার আসলে কোন ভিওি নেই৷ পুঁজিবাজারের অন্যান্য লেনদেনের মতই একই পদ্ধতিতে এক্ষেত্রেও লেনদেন হয়৷ চাহিদা তৈরী করতে আমাদের অনেক প্রচারণা মূলক পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। বাংলাদেশে ব্যাংকের দেয়া একটা বন্ড ব্যর্থ হওয়ার কোন কারণ নেই৷ এটা সাধারণ বিনিয়োগকারীগনের সঠিক প্রচারণার মাধ্যমেই বুঝাতে হবে৷

তিনি আরও বলেন, আমরা বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থাও নিয়েছি৷ যার ধারাবাহিকতায় বিআইসিএম, ডিএসই এবং সিএসইও প্রশিক্ষণ প্রদান করছে৷ এক্ষেত্রে লেনদেনের পদ্ধতি সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ যদি দেয়া যায় তাহলে সাধারণ বিনিয়োগকারীগন সরকারী সিকিউরিটিজ এ বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবেন৷ আর যোগান বা সাপ্লাইয়ের ক্ষেত্রে এ পর্যন্ত যে সমস্ত বন্ড ইস্যু করা হয়েছে সেগুলো বিপিআইডি হোল্ডারাই হোল্ড করেন৷ সেটার একটা অংশ যদি এই মার্কেটের মাধ্যমে সঞ্চালন করা যায় তাহলে পুঁজিবাজার আরও প্রাণবন্ত হবে৷

তার আগে বৈঠকের শুরুতেই স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন ডিএসই’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) এম. সাইফুর রহমান মজুমদার। স্বাগত বক্তব্য তিনি বলেন, সরকারি সিকিউরিটিজ লেনদেন করার জন্য একটা টেকনিক্যাল প্লাটফর্ম দাঁড় করানো হয়েছে৷ যা পরিপূর্ণ ডেট বোর্ড৷ সরকারি সিকিউরিটিজগুলো ধারণ করছে মূলতঃ ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো৷ তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের প্লাটফর্মে কেনা বেচা করছে৷ ডিএসইতে যে প্লাটফর্ম দেয়া হয়েছে, সেখানে বিক্রেতা হচ্ছে ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান৷ মার্কেট গতিশীল হবে তখনি, যখন প্রতিষ্ঠানগুলো এই মার্কেটে বিক্রি করবে৷ ডিএসই প্লাটফর্মে যখন বিক্রয় করবে তখনি সাধারণ পাবলিক এ সিকিউরিটিজ কিনতে পারবে৷ সাধারণ বিনিয়োগকারীর অংশগ্রহণ বাড়লেই মার্কেটে তারল্য বাড়বে৷ সরকারী সিকিউরিটিজে শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদেরই বিনিয়োগ থাকবে, সাধারণ বিনিয়োগকারীগনের বিনিয়োগ অনেক কম থাকে৷ যার ফলে, বছর দুয়েক আগে থেকে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশনের তত্ত্বাবধানে এই কাজ শুরু হয়, যাতে সাধারণ বিনিয়োগকারীগনেরও একটা অংশগ্রহণ এতে থাকে৷

তিনি বলেন, প্রযুক্তিগত পুনর্বিন্যাস করতে গিয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ, চিটাগাং স্টক এক্সচেঞ্জ, সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সিস্টেম এর সাথে একীভূত হতে বেশ কিছু সময় লেগেছে৷ সব প্রতিষ্ঠান একসাথে এমওইউ সাইন করেছে৷ পরীক্ষা মূলক লেনদেন চালু করার পর দেখা গেল, সাধারণ বিনিয়োগকারীগণের আগ্রহ থাকার পরও বাজারে সাপ্লাই দেয়া যাচ্ছেনা৷ এর বড় কারণ হলঃ আড়াইশো সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হয়েছে তার সবগুলো বর্তমানে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীগনের হাতে রয়েছে৷ যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করেছেন তাদেরও একটি বড় অংশের লেনদেন হয়না, তার একটি অংশের প্রতিদিনই বাংলাদেশ ব্যাংকের প্ল্যাটফর্মে লেনদেন হচ্ছে৷ সেখানেও অংশগ্রহণ যে খুব বেশি তা নয়, কিন্ত প্রাতিষ্ঠানিক অংশগ্রহণের কারণেই উল্লেখযোগ্য পরিমাণে লেনদেন হচ্ছে সেখানে। পুঁজিবাজারকে প্রাণবন্ত করতে এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীগনকে এই সুবিধা দিতে হলে সাধারণ বিনিয়োগকারী এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীগনের অংশগ্রহণ যতক্ষন পর্যন্ত না একীভূত হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত এটা নিশ্চিত করা যাবে না৷

তিনি আরও বলেন, আজকের এই বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য হলো যেসব প্রতিষ্ঠানের কাছে সরকারী সিকিউরিটিজ রয়েছে সেগুলোর কিছু অংশ ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্লাটফর্মে যেন লেনদেন করা যায় সে জন্য প্রদান করা৷

পরে ব্যাংকের প্রাইমারি ডিলারগণ স্টক এক্সচেঞ্জ প্লাটফর্মে সরকারি সিকিউরিটিজ লেনদেনের প্রধান চ্যালেঞ্জসমুহ যেমন-বাংলাদেশ ব্যাংক ও এক্সচেঞ্জের ট্রেডিং সেটেলমেন্টের পার্থক্য, বন্ড ও এর মূল্য নির্ধারণের পদ্ধতি সম্পর্কে ব্রোকারেজ হাউজের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা, কর বিষয়ক সমস্যা, ব্রেকারেজ কমিশন, সার্কিট ব্রেকার, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যাংকের জন্য বাজার মূল্যায়ন সমস্যার চিহ্নিত করন, বিনিয়োগকারীদের জ্ঞানের অভাব, টি+২ ট্রেডিং সেটেলমেন্টের কারণে ব্যাংকের অ্যাকাউন্টিং সিস্টেমের সমস্যা, বিপিআইডি ও বিও আইডি সিকিউরিটিজ ট্রান্সফার ইস্যু, তারল্যের উপর ভিত্তি করে সরকারি সিকিউরিটিজের বেঞ্চমার্কিং না থাকা৷ মেয়াদপূর্তি ভিত্তিতে সমস্ত গর্ভমেন্ট সিকিউরিটিজ ব্যতীত বন্ড বিষয়ে পুঁজিবাজারে সীমিত ব্যাংক এক্সপোজার এবং ব্যাংক নিলাম ও সেকেন্ডারি ট্রেডিং এর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আন্ডাররাইটিং কমিশন ইত্যাদি বিষয়ে ডিলারগণ আলোচনা করেন৷

অনুষ্ঠানের সভাপতি ডিএসই’র চেয়ারম্যান মোঃ ইউনুসুর রহমান সমাপনী বক্তব্যে বলেন, বাংলাদেশ সামাজিক উন্নয়নে এগিয়ে থাকলেও আর্থিক খাতে অনেক পিছিয়ে আছে। এই খাতের উন্নয়ন করতে না পারলে দেশের টেকসই উন্নয়ন করা কঠিন হয়ে পড়বে। তবে আশার কথা হচ্ছে, বর্তমানে আমাদের যে নিয়ন্ত্রক সংস্থা রয়েছে তারা অত্যন্ত গতিশীল ও কর্মতত্পর, তারা নতুন নতুন প্রোডাক্ট বাজারে নিয়ে আসার চেষ্টার পাশাপাশি অনেক ভাল কাজ করছে।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বিগত এক বছরে অনেক উন্নতি সাধিত হয়েছে। আমাদের মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন বেড়েছে, যা নিঃসন্দেহে উন্নয়নের নির্দেশক। কিন্ত সার্বিক পুঁজিবাজার নিয়ে গর্ব করার মত উচ্চতায় পৌঁছতে আরও সময় লাগবে।

সরকারী সিকিউরিটিজের পুঁজিবাজারে চালু হওয়ার ফলে দেখলাম যে আমাদের বাজার মূলধন পাঁচ লক্ষ বিশ হাজার থেকে সাত লক্ষ সত্তর হাজারে উন্নীত হয়েছে। লেনদেনের পরিমাণ বৃদ্ধি পাক বা না পাক বাজার মূলধন আড়াই লক্ষ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের মার্কেট ক্যাপ টু জিডিপি ১৫ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এই যে আমাদের আড়াই লক্ষ কোটি টাকার বাজার মূলধন বৃদ্ধি পেল এটার একটা সুবিধা আমাদের নিতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের অতিরিক্ত পরিচালক এম. আনোয়ার হোসেন বলেন, সরকারী সিকিউরিটিজ লেনদেনের ক্ষেত্রে যেকোনো ধরনের সহযোগিতা করতে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রস্তুত। তিনি সকলকে আহবান জানিয়ে বলেন, আপনারা শুরু করুন তাহলেই এই প্লাটফর্মে সরকারী সিকিউরিটিজের ব্যাপকতা ও প্রসারতা বৃদ্ধি পাবে।

শেয়ার দিয়ে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *