দীর্ঘ ১২ বছর পর রাজস্ব আয়ে রেকর্ড ছুঁয়েছে বেনাপোল কাস্টম হাউজ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আমদানি পণ্য থেকে পাঁচ হাজার ৯৪৮ কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এর বিপরীতে আদায় হয়েছে ছয় হাজার ১৬৫ কোটি টাকা। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২১৬ কোটি ৫৯ লাখ টাকা বেশি। এসময় বেনাপোল বন্দর দিয়ে ভারত থেকে আমদানি হয়েছে ১৭ লাখ ২১ হাজার ৭৮০ টন পণ্য।
কাস্টম সূত্র জানায়, বিদায়ী অর্থবছরে (২০২৩-২৪) সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় হয়েছে ফেব্রিকস, পচনশীল দ্রব্য, ইংগড, ট্রাক চেচিস, মোটরপার্টস এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল কাঁচামাল। সর্বোচ্চ রাজস্ব প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ছিল আমদানিকারক পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি বিডি, এসএমসিএল নিলয় ও এসএম করপোরেশন।
বৈশ্বিক মন্দার মধ্যে এ অর্জন পদ্মা সেতুতে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্রে কাস্টম বন্দরের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও বন্দরে নতুন নতুন উন্নয়ন প্রকল্পের সুফল বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য সংশ্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বেনাপোল বন্দরে আমদানি পণ্য থেকে সরকারের রাজস্ব এসেছিল ৫ হাজার ৭৮৬ কোটি ২৩ লাখ টাকা। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৮০ কোটি টাকা কম আদায় হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে ঘাটতি দেখা দেয় ১ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে রাজস্ব ঘাটতি ছিল ২ হাজার ৫৭ কোটি টাকা। এছাড়া ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১৭৯ কোটি ৬৪ লাখ টাকা রাজস্ব ঘাটতি ছিল।
২০১৬-১৭ অর্থবছরে বেশি আদায় হয়েছিল ৪৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা। তার আগের বছরগুলাতে শুধু ঘাটতিই হয়েছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২০৩ কোটি টাকা, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১৩৪ কোটি ৭৩ লাখ টাকা, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৪৫২ কোটি ৮৯ লাখ টাকা এবং ২০১১-১২ অর্থবছরে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১৯৪ কোটি টাকা।
দেশের ১৩টি স্থলবন্দরের মধ্যে বেশি রাজস্ব আয় হয় বেনাপোলে। রাজস্ব আয়ের দিক থেকে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের পর বেনাপোল স্থলবন্দরের অবস্থান। তবে আরও বেশি বাণিজ্যের চাহিদা থাকলেও সুষ্ঠু বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যোগাযোগব্যবস্থা আর অবকাঠামোগত নানান প্রতিবন্ধকতার কারণে ঠিকমতো কাজ করতে পারতেন না আমদানিকারকরা। এতে গত ১২ বছর ধরে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারছিল না বেনাপোল কাস্টম হাউজ। অবশেষে, ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে বর্তমান সরকার সবচেয়ে বেশি অবকাঠামো উন্নয়ন করে বেনাপোল বন্দরে। এর পাশাপাশি পদ্মা সেতুর কারণে যোগাযোগব্যবস্থা সহজ হওয়ায় অন্য বন্দর ব্যবহারকারীরাও আমদানি শুরু করেন বেনাপোল দিয়ে। সবমিলিয়ে রেকর্ড পরিমাণ রাজস্ব আয় করেছে বেনাপোল কাস্টম হাউজ।
বেনাপোল আমদানি রপ্তানিকারক সমিতির সিনিয়র সহসভাপতি আমিনুল হক বলেন, ‘বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, ডলার সংকটের কারণে গত কয়েক বছর ধরে এলসির সংখ্যা কমিয়েছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। ফলে আমদানি কমে গিয়ে বছরের শুরুতেই রাজস্ব ঘাটতি দেখা দেয়। অর্থবছরের শেষের দিকে বড় বড় মেগা প্রকল্পের পণ্য ও উচ্চ শুল্কের পণ্য আমদানি বৃদ্ধি পাওয়ায় রাজস্ব আয়ও বেড়েছে।’
পদ্মা সেতুর কারণে যোগাযোগব্যবস্থা সহজ হওয়ায় ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্য বেড়েছে বলে জানান বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের আন্তর্জাতিক চেকপোস্ট বিষয়ক সম্পাদক সুলতান মাহমুদ বিপুল।
তিনি বলেন, বন্দরের অবকাঠামো উন্নয়নের ফলে ব্যবসায়ীরা বেনাপোল বন্দর বেশি ব্যবহার করেছেন। এছাড়া এ বছরের শেষের দিকে বেনাপোল বন্দরে নির্মাণাধীন কার্গো ভেহিকেল টার্মিনাল চালু হবে। এতে ব্যাপক সুবিধা যোগ হবে বন্দরে। তখন এপথে রাজস্ব আয় আরও বাড়বে।
বেনাপোল স্থলবন্দর পরিচালক রেজাউল করিম বলেন, রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্রে কাস্টমসের পাশাপাশি বন্দরের ভূমিকাও রয়েছে। তাদের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, বন্দরে অটোমেশন প্রক্রিয়া চালু, অবকাঠামো উন্নয়ন ও পণ্যের ওজন স্কেলের সঠিক পরিমাপের কারণে রাজস্ব আয়ে এবার রেকর্ড হয়েছে।
বেনাপোল কাস্টম হাউজের যুগ্ম-কমিশনার সাফায়েত হোসেন জানান, অর্থবছরের শেষের দিকে উচ্চ শুল্কহারের পণ্য বেশি আমদানি এবং সরকার শুল্কহার বাড়ানোয় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় হয়েছে। রাজস্ব ফাঁকি রোধে এ বন্দরে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে। অনিয়ম ধরা পড়লে রাজস্ব পরিশোধপূর্বক ২০০ শতাংশ জরিমানা আদায় করা হচ্ছে।