নভেম্বর ১৬, ২০২৪

নেদারল্যান্ডের সাবেক সংসদ সদস্য ও মানবাধিকারকর্মী হ্যারি ভ্যান বোমেল জানিয়েছেন, স্বাধীনতার একান্ন বছরেও ১৯৭১ সালে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চালানো গণহত্যার স্বীকৃতি পায়নি বাংলাদেশ। এর অন্যতম কারণ মুক্তিযুদ্ধের সময় চলমান স্নায়ুযুদ্ধ এবং তখনকার বৈশ্বিক সুপার পাওয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তানকে সমর্থন।

ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য গণহত্যার স্বীকৃতি বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন উপলক্ষে এক প্রেস মিটে এসব কথা বলেন নেদারল্যান্ডের সাবেক সংসদ সদস্য ও মানবাধিকারকর্মী হ্যারি ভ্যান বোমেল। রোববার (২১ মে) দুপুরে জাতীয় প্রেস ক্লাবে এই আয়োজন করা হয়।

গণহত্যার স্বীকৃতি পেতে এত দেরি কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে যখন মুক্তিযুদ্ধ চলছিল তখন স্নায়ুযুদ্ধের জন্য বিশ্ব দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষ নেয় ও তাদের অস্ত্র সরবরাহ করে। অন্যদিকে ভারত তখন রাশিয়ার পক্ষে তাই সঙ্গত কারণেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে গণহত্যার বিষয়ে জানলেও না জানার ভান করে। পশ্চিমারা পাকিস্তানকে বন্ধু ভাবায় এতদিন ধরে বাংলাদেশে সংগঠিত গণহত্যার স্বীকৃতি আদায় করা যায়নি।

এটি আদায়ে আর কত সময় লাগতে পারে এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আর্মেনিয়ান গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে একশ বছর লাগলেও বাংলাদেশি গণহত্যার স্বীকৃতি পেতে অত সময় লাগবে না বলে আশা করি। কয়েক দশকও নয়, আমরা কয়েক বছরের মধ্যেই এটা পেতে চাই।’

রোববার (২১ মে) জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘বাংলাদেশ জেনোসাইড স্বীকৃতি অর্জনের জন্য আন্তর্জাতিক সম্মেলন-২০২৩’ উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে আমরা একাত্তর, প্রজন্ম একাত্তর ও ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ ফোরাম (ইবিএফ)।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বাংলাদেশ গণহত্যার পক্ষে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে বিশ্বব্যাপী জনমত আদায়ে এই সম্মেলন আয়োজন করা হয়েছে। আগামীকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একদিনের এই আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি সংসদ সদস্য অ্যারোমা আরমা দত্ত বলেন, ‘আমি নিজে একজন শহীদ সন্তান। বাংলাদেশে বিশ্বের সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক গণহত্যা ঘটে যা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দাবি করে। জাতিসংঘ এই স্বীকৃতি দিতে বাধ্য। আমাদের দাবি আদায়ে একসঙ্গে কাজ করার জন্য ইউরোপীয় পার্লামেন্টের বন্ধুদের ধন্যবাদ।

বিশেষ অতিথি জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, ‘১৯৭১ সালের প্রতিটি ঘটনাই গণহত্যার যা দেশে-বিদেশে দৃষ্টি আকর্ষণ প্রয়োজন। বাংলাদেশি গণহত্যা নিয়ে ইইউ পার্লামেন্ট ও ইউএস কংগ্রেসে আলোচনা হয়েছে যা গুরুত্বপূর্ণ।’

আমস্টারডামের ভিরহে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধাপক ড. এ্যানথনি হলসম্যান এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘বাংলাদেশে গণহত্যার বৈজ্ঞানিক গবেষণার কাজ এখনও চলমান। এটি শেষ হলে স্বীকৃতি আদায়ে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।

অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন ‘আমরা একাত্তরে’র চেয়ারপারসন বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুব জামান। আয়োজন সম্পর্কে তিনি জানান, তারা ২০২০ সাল থেকে ১৯৭১ সালের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে আন্তর্জাতিক মহলে কাজ করছেন। এ উপলক্ষে তারা বাংলাদেশে দূতাবাস আছে এমন সবগুলো দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করছে যাতে সেসব দেশের সংসদে এটি নিয়ে আলোচনা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় এবারের আন্তর্জাতিক সম্মেলন যেখানে ইউরোপীয় প্রতিনিধিরাও অংশ নিচ্ছেন যারা এই গণহত্যার স্বীকৃতি চান। বিদেশি প্রতিনিধিরা আগামী এক সপ্তাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনোসাইড স্টডিজ বিভাগ ঘুরে দেখবেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ দমন ট্রাইবুন্যালের প্রধান প্রসিকিউটরের সঙ্গে দেখা করবেন, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সঙ্গে দেখা করবেন, মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে দেখা করবেন, রায়েরবাজার ও জল্লাদখানা বধ্যভূমি পরিদর্শন করবেন, বঙ্গবন্ধু জাদুঘর ও জাতীয় জাদুঘর পরিদর্শন করবেন এবং পরে চট্টগ্রাম ভ্রমণ করবেন।

যুক্তরাজ্যের সিনিয়র সাংবাদিক ক্রিস ব্ল্যাকবার্ন বলেন, ‘আমি আমার জীবনের ২০ বছর কাটিয়েছি বাংলাদেশের গণহত্যা বিষয়ে পড়াশোনা করে। এই সম্মেলন ও ভ্রমণের মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশে কী ঘটেছিল তা আরও ভালোভাবে জানতে চাই।’

তিনি আরও বলেন, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ দমন ট্রাইবুনালের মাধ্যমে যুদ্ধাপরধীদের বিচার প্রক্রিয়ার ফলে এক ধাপ এগোনো গেছে। এখন পরবর্তী ধাপ পাকিস্তান বাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশে গণহত্যা, ধর্ষণ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।’

ইবিএফ-এর যুক্তরাজ্য শাখার সভাপতি আনসার আহমেদ উল্লাহ বলেন, ‘গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য গণহত্যার শিকার ব্যাক্তিদের সাক্ষাৎকার নেবেন। পরবর্তীতে ইউরোপের বিভিন্ন পার্লামেন্টে স্বীকৃতির বিষয়টি তুলে ধরা হবে।’

নেদারল্যান্ডসের প্রবাসী সংগঠন বাংলাদেশ সাপোর্ট গ্রুপের (বাসুগ) চেয়ারম্যান বিকাশ চন্দ্র বড়ুয়া বলেন, ‘আর্মেনিয়ান গণহত্যার স্বীকৃতি পেতে একশ বছর লেগেছে। আমরা এতদিন লাগুক তা চাই না। বাংলাদেশের জন্মের ৫১ বছরেও গণহত্যার স্বীকৃতি মেলেনি তার মধ্যে অন্যতম কারণ আমাদের রাজনৈতিক বিভেদ যা বিদেশেও বিদ্যমান। সব পক্ষ মিলে চাইলে এই কাজ আরও দ্রুত হবে বলে আশা করি।’

সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ সন্তান ও শহীদ পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

 

শেয়ার দিয়ে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন...