সাম্প্রতিক বেলুনকাণ্ড ঘিরে গভীর দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। গত প্রায় দু-সপ্তাহ ধরে এ ইস্যুকে কেন্দ্র করে দুই দেশের মধ্যে যে কূটনৈতিক তিক্ততা শুরু হয়েছে, তার প্রভাব ইতোমধ্যে পড়া শুরু করেছে দুই দেশের বিভিন্ন মিত্ররাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে।
সর্বশেষ শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এক বক্তব্যে বলেন, চীনের নজরদারি বেলুন ভূপাতিত করাকে ঘিরে তার কোনো দুঃখ বা পরিতাপবোধ নেই এবং এই কারণে তিনি দেশটির কাছে কখনো ক্ষমা চাইবেন না।
তার এই বক্তব্যের এক ঘণ্টার মধ্যেই পাল্টা বিবৃতি দেয় চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সেখানে বলা হয়, ‘ক্ষমা বা পরিতাপবোধ জানানোর জন্য প্রথমে আলোচনায় বসতে হবে। প্রতিনিয়ত বিশ্বজুড়ে সংঘাত-সহিংসতা উস্কে দেওয়াই যাদের প্রধান কাজ, তাদের সঙ্গে আলোচনার কোনো প্রশ্নই আসে না।’
গত জানুয়ারির শেষের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে প্রথমবারের মতো ‘সন্দেহজনক’ একটি বেলুন উড়তে দেখা যায়। বেলুনটি চীন থেকে এসেছে—শনাক্ত করে দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা তথ্য নিতেই এই নজরদারি বেলুন পাঠিয়েছে চীন।
মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অভিযোগের জবাবে বেলুনটির মালিকানা স্বীকার করেন চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সেই সঙ্গে চীনা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, এটি কোনো গোয়েন্দা নজরদারি বেলুন নয়। আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করতে বেলুনটি ওড়ানো হয়েছিল; পরে বাতাসের গতিবেগে দিক হারিয়ে সেটি যুক্তরাষ্ট্রের আকাশসীমায় চলে গেছে।
গত ৪ ফেব্রুয়ারি বিমান বাহিনীর ফাইটার জেট থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে বেলুনটি ধ্বংস করে মার্কিন প্রতিরক্ষা বাহিনী। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নিজে বেলুনটি ধ্বংসের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তারপরের প্রায় দু-সপ্তাহে আরও নিজেদের আকাশসীমা থেকে আরও কয়েকটি বেলুন ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে নামিয়েছে মার্কিন বিমান বাহিনীর ফাইটার জেট। বলা বাহুল্য, ভূপাতিত করা সব বেলুনই চীন থেকে এসেছিল।
কিন্তু এসব বেলুন ঘিরে গত প্রায় দু’সপ্তাহে বেইজিং ও ওয়াশিংটন যেভাবে পরস্পরের বিরুদ্ধে বিরোধপূর্ণ পাল্টা বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে, তা ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক বিশ্বের মনোযোগ কাড়তে সক্ষম হয়েছে এবং বলা যায়, জাতীয় নিরাপত্তা ও ভূরাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে এই বেলুনকাণ্ড সম্ভাব্য প্রভাবই বর্তমানে আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রধান আলোচিত বিষয়।
যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ— গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের জন্য অন্য দেশের আকাশসীমায় নজরদারি বেলুন পাঠানো গুরুতর অন্যায়, অন্যদিকে চীনের দাবি— বেসামরিক বেলুনকে গোয়েন্দা নজরদারি বেলুন বলে প্রচারের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র একটি ‘নিরীহ’ বিষয়কে ইস্যু করতে চাইছে এবং এর পেছনে দেশটির গভীর কোনো অভিসন্ধি আছে।
দুই দেশের বর্তমান বিরোধপূর্ণ অবস্থান নিয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্বে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হওয়া সত্ত্বেও বেইজিং ও ওয়াশিংটন নিজেদের অবস্থান থেকে এখন পর্যন্ত একবিন্দু নড়েনি।
এদিকে, বেইজিং-ওয়াশিংটনের সাম্প্রতিক এই কূটনৈতিক বচসা চলার মধ্যেই নড়েচড়ে বসছে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররা। চীনের বিরুদ্ধে ‘বেলুন পাঠিয়ে নজরদারির’ অভিযোগ তুলছে তারাও। চলতি সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ এশীয় মিত্র জাপান প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছে যে— ২০১৯ সাল থেকে ’২২ সালের মধ্যে জাপানের আকাশসীমায় অন্তত তিন বার বেলুন পাঠিয়েছে চীন।
একই অভিযোগ জানিয়েছে এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের অপর গুরুত্বপূর্ণ মিত্র তাইওয়ানও। ব্রিটেনের দৈনিক দ্য ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেন, সম্প্রতি তাইওয়ানের আকাশসীমায় অন্তত এক ডজন চীনা সামরিক বেলুন শনাক্ত হয়েছে। তবে চীনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব বৃদ্ধির আশঙ্কায় সেই বেলুনগুলো গুলি করে নামানো থেকে বিরত থেকেছে তাইওয়ানের সেনাবাহিনী।