কয়েকটি দলের বয়কট মানেই নির্বাচন অবৈধ হয়েছে কিংবা অংশগ্রহণমূলক হয়নি, এমন বলা যায় না বলে মন্তব্য করেছেন সাউথ এশিয়া ডেমোক্রেটিক ফোরামের নির্বাহী পরিচালক পাউলো কাসাভা। আজ সোমবার বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট পর্যবেক্ষণের অভিক্ষতা নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ মন্তব্য করেন তিনি।
পাউলো কাসাভা বলেন, নির্বাচন বয়কট মানেই এই নয় যে নির্বাচন অবৈধ কিংবা অংশগ্রহণমূলক হয়নি। আমরা নারায়নগঞ্জ গিয়েছি, সেখানে বহু মানুষ স্বাধীন ভাবে ভোট দিয়েছে। আমাদের ঘুরে দেখা কেন্দ্রগুলোতে নারী ও তরুণ ভোটারদের অংশগ্রহণ যথেষ্ট ভালো ছিলো। প্রিসাইডিং অফিসাররা দারুণভাবে কাজ করেছেন।
তিনি বলেন, নির্বাচনে না এসে বিএনপি খেলার বাইরে নিজেকে নিয়ে গেছে। ট্রেন মিস করেছে। যে ভুল আগামীতে দলটি করবে না বলে আশাপ্রকাশ করেন তিনি।
২০১৪ সালের মতো এবারের নির্বাচনও বয়কট করে ভোটের বাইরে থেকেছে বিএনপি। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানে হাতে গড়া দলটি গত এক দশকের মধ্যে এ নিয়ে দুই সংসদীয় নির্বাচনে ভোটের বাইরে থাকলো, যা নির্বাচনমুখী রাজনৈতিক দলের ভবিষ্যৎ অস্তিত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন অনেকে।
রোববার অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া নির্বাচনকে বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ ভোটের নজির স্থাপনকারী হিসেবে দেখছে দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকরা। ৪০ শতাংশের মতো ভোট পড়েছে, যা স্বস্তি দিয়েছে নির্বাচন আয়োজকদের।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং বেশ কয়েকটি দেশের পর্যবেক্ষকেরা। আমন্ত্রিত বিদেশি পর্যবেক্ষকেরা বাংলাদেশের সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনের পরিবেশের প্রশংসা করেছেন।
রোববার সন্ধ্যায় রাজধানীর একটি হোটেলে জাতীয় নির্বাচনের ভোট পর্যবেক্ষণ শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ফিলিস্তিনের প্রধান নির্বাচন কমিশনার হাশিম কুহাইল বলেন, ভোট শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ ছাড়া ভোটের পরিবেশও খুব ভালো ছিল। নাগরিকদের ভোটদান প্রক্রিয়াও খুব সহজ ছিল।
কানাডার পার্লামেন্ট সদস্য চন্দ্রকান্ত আর্য বলেন, ভোট সুষ্ঠুভাবে শেষ হয়েছে। ভোটে রেকর্ডসংখ্যক নারী ভোটার উপস্থিত ছিলেন। আমরা নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী ভোটকেন্দ্রে গিয়ে লোকজনের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেয়েছি। সুষ্ঠু ভোট প্রক্রিয়ার জন্য নির্বাচন কমিশনকে অভিনন্দন জানাই।
কানাডার এই পর্যবেক্ষক আরও বলেন, যারা ভোট বর্জন করেছে, সেটা তাদের বিষয়, এটা আমাদের বিষয় না। কানাডায়ও ভোট ৪৩ শতাংশ পড়েছিল, সেটা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেনি। জনগণ ভোট দিতে পারছে কি না, এটাই দেখার বিষয়। ভোটার কত শতাংশ এলো তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যারা এসেছে, তারা ঠিকমতো ভোট দিয়েছে নির্বিঘ্নে। তাই এ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কারণ নেই।
নাইজেরিয়ার সিনেটর প্যাট্রিক সি বলেন, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ জেলার বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র পরিদর্শন করে স্থানীয় লোকজনকে উৎসাহের সঙ্গে ভোট দিতে দেখেছেন তিনি। শান্তিপূর্ণভাবে ভোট হয়েছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
সাউথ এশিয়া ডেমোক্রেটিক ফোরামের নির্বাহী পরিচালক পাওলো কাসাকা বলেন, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে। তবে প্রধান বিরোধী দল এলে নির্বাচন আরও অংশগ্রহণমূলক হতো। স্বচ্ছ ভোটার তালিকা ও ভোটপদ্ধতির প্রশংসা করেন তিনি।
পাওলো কাসাকা বলেন, যারা নির্বাচন বর্জন করেছে, তদের দ্রুত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফিরে আসা উচিত।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর ১৯৭৩ সালে প্রথম নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় নিয়ে ক্ষমতায় আসে স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়া আওয়ামী লীগ।এরপর প্রায় দেড় দশকের সামরিক শাসন এবং আরো দশ বছর সংসদীয় গণতন্ত্রের আড়ালে ধর্মীয় চরমপন্থিদের উত্থানের সময় বেশ ভুগতে হয়েছিলো দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলটিকে। কিন্তু ২০০৮ সাল থেকে রাজনৈতিকভাবে দৃঢ় ও সংগঠিত আওয়ামী লীগের সামনে আর দাঁড়াতেই পারেনি সামরিক শাসকদের হাতে তৈরি এবং ধর্মীয় মতাদর্শের ওপর গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দলগুলো।
রোববার অনুষ্ঠিত হওয়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৯৮টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ পেয়েছে ২২৫ আসন বা তিন চতুর্থাংশ। বাকী আসনগুলোর মধ্যে স্বতন্ত্র ৬১, জাতীয় পার্টি ১১ ও কল্যাণ পার্টি পেয়েছে ১টি আসন।
৩০০ সংসদীয় আসনের মধ্যে এক প্রার্থীর মৃত্যুতে একটি আসনে ভোট হয়নি, আর এক আসনের একটি কেন্দ্রে ভোট স্থগিত থাকায় ফল ঘোষণা করা হয়নি।
দেশের ৪৪টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২৭টি দল ভোটে অংশ নেয়। কিন্তু ২২টি দল কোনো আসন পায়নি। অপেক্ষাকৃত নতুন রাজনৈতিক দলগুলো ভোটারদের মাঝে সাড়া ফেলতে ব্যর্থ হয়েছে।
গত দুই সংসদে বিরোধীদলের ভূমিকা পালন করা জাতীয় পার্টির জন্য এবার ২৬টি আসনে ছাড় দেয় আওয়ামী লীগ। ওই আসনগুলোতে নৌকার প্রার্থী না থাকলেও বেশিরভাগ জায়গাতেই হেরেছে প্রয়াত সাবেক সেনাশাসক এরশাদের হাতে গড়া রাজনৈতিক দলটি প্রার্থীরা।
গতবারের তুলনায় জাতীয় পার্টি আসন সংখ্যা একটানে নেমেছে অর্ধেকে। লাঙ্গলের প্রার্থীরা জিততে পেরেছে ১১টি আসনে।
যদিও দলটি প্রথমে ২৮৯ আসনে দলীয় লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী দেয়। পরে কয়েকটি আসন থেকে প্রত্যাহার করে নেয় এবং কিছু প্রার্থী স্বেচ্ছায় বসে পড়ে।
কিন্তু ভোটের মাঠে লাঙ্গলের প্রার্থীদের মারাত্মক চ্যালেঞ্জে ফেলে দেয় স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। এদের কারণেই আওয়ামী লীগের ছেড়ে দেয়া ১৫টি আসনে জিততে ব্যর্থ হয়েছে জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা।
অংশগ্রহণমূলক ভোটের স্বার্থে এবারের নির্বাচনের শুরুতেই দলীয় নেতাদের জন্য স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সুযোগ উন্মুক্ত করে দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
তাই এবার রেকর্ড সংখ্যক স্বতন্ত্র প্রার্থী দেখা যায় ভোটের মাঠে। জাতীয় পার্টির পাশাপাশি আওয়ামী লীগেরও অনেক প্রার্থীকে নাকানিচুবানি খেতে হয়েছে স্বতন্ত্রের হাতে। এদের মধ্যে রয়েছেন কয়েকবার নির্বাচিত হওয়া অনেক অনেক ভেটেরান সংসদ সদস্য।
মোট সংসদীয় আসনের প্রায় ২০ শতাংশ জিতেছে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। বাংলাদেশের সংসদীয় ইতিহাসে এর আগে আর কখনো এতো স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য দেখা যায় নি।