ডিসেম্বর ১৮, ২০২৪

ঋণখেলাপি এবং একক গ্রাহকের সীমা অতিক্রম করা কোনো প্রতিষ্ঠানকে নতুন করে ঋণ দেওয়ার সুযোগ নেই। এই দুটি নিয়ম লঙ্ঘন করা বেক্সিমকো গ্রুপকে তবুও ঋণ দিতে যাচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক। এক্ষেত্রে ব্যাংক কোম্পানি আইনের দুটি ধারা থেকে জনতা ব্যাংককে অব্যাহতি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সরকারের সঙ্গে পরামর্শ করে গত সপ্তাহে এ অব্যাহতি দেওয়া হয়। এ বিষয়ে গত ১২ ডিসেম্বর ব্যাংকটি বরাবর চিঠি পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ বিষয় নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক ও সহকারী মুখপাত্র মোহাম্মদ শাহরিয়ার সিদ্দিকী।

জানা গেছে, ২৮ নভেম্বর বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের আওতাধীন শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রম ও ব্যবসায়িক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করার দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির প্রথম সভা শ্রম উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের আওতাধীন ইউনিটগুলোতে নিযুক্ত শ্রমিকদের আগামী তিন মাসের বেতন পরিশোধে প্রয়োজনীয় অর্থ প্রদানে জনতা ব্যাংক সহায়তা করবে।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেক্সিমকো গ্রুপ জনতা ব্যাংকের শীর্ষ ঋণখেলাপি। একই সঙ্গে একক ঋণগ্রহীতার ঋণসীমা লংঘন করা প্রতিষ্ঠানও। ১৯৯১ সালের ব্যাংক কোম্পানি আইনের ধারা ২৭ (ক) অনুযায়ী কোনো খেলাপি ঋণগ্রহীতার অনুকূলে নতুন করে ঋণ সুবিধা দেওয়ার সুযোগ নেই। এ ছাড়া একই আইনের ২৬ (খ) ধারা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকের শর্তাবলি অনুযায়ী কোনো গ্রাহকের অনুকূলে ব্যাংকের রক্ষিত ও পরিশোধিত মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি ঋণ দেওয়া যাবে না। এমন পরিস্থিতিতে জনতা ব্যাংক বেক্সিমকো গ্রুপের অনুকূলে ঋণ দেওয়ার জন্য আইনের দুটি ধারা থেকে অব্যাহতি চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করে। পরে বাংলাদেশ ব্যাংক আবেদনটি বিবেচনা নিয়ে দুটি ধারা থেকে অব্যাহতি দেয়।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র শাহরিয়ার সিদ্দিকী বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক চাইলে সরকারের সঙ্গে পরামর্শ করে অব্যাহতি দিতে পারে। বেক্সিমকোর ইউনিটগুলোর তিন মাসের বেতন পরিশোধের জন্য

এই অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। কারণ এ ধরনের সুবিধা না দেওয়া হলে শ্রমিক অসন্তোষ সৃষ্টি হতে পারে। এমন সুবিধা দেওয়ার নজির আগেও ছিল।

সূত্রগুলো বলছে, জনতা ব্যাংককে ডোবাতে যে কটি গ্রুপ দায়ী তার মধ্যে অন্যতম বেক্সিমকো। বেক্সিমকো গ্রুপ এখন পর্যন্ত জনতা ব্যাংক থেকে ২৩ হাজার ৩২৮ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে, যার পুরো ঋণই এখন খেলাপি হয়েছে। বেক্সিমকো ছাড়া ব্যাংকটির শীর্ষ খেলাপি গ্রাহকের মধ্যে আরও রয়েছে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম। ব্যাংকটিতে এস আলম গ্রুপের ঋণ ১০ হাজার ১০০ কোটি টাকা, যা খেলাপি হয়ে গেছে। জনতা ব্যাংকের আলোচিত আরেক গ্রাহক এননটেক্স গ্রুপের খেলাপির পরিমাণ ৭ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা। আরেক গ্রাহক চামড়া খাতের আলোচিত ক্রিসেন্ট গ্রুপের খেলাপি ৩ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা। এ ছাড়া ব্যাংকটিতে থার্মেক্স গ্রুপের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ৮৯৮ কোটি টাকা। এই ঋণ খেলাপি হলেও আদালতের আদেশে তা খেলাপি হিসেবে নথিভুক্ত করতে পারছে না ব্যাংকটি। এ ছাড়া ব্যাংকটিতে আওয়ামী লীগের মেয়াদে ব্যবসা শুরু করা রানকা গ্রুপের খেলাপি ঋণ ১ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা, রতনপুর গ্রুপের ১ হাজার ২২৭ কোটি টাকা, শিকদার গ্রুপের ৮২৯ কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জনতা ব্যাংক এক সময় দেশের ভালো ব্যাংক হিসেবে পরিচিত ছিল। ব্যাংকটির অর্থায়নে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন অনেক শিল্পোদ্যোক্তা। সেই ব্যাংক এখন খেলাপি ঋণের শীর্ষে। গত ১৫ বছরে বড় ধরনের ঋণ অনিয়ম ও জালিয়াতির ঘটনাও ঘটেছে ব্যাংকটিতে, যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন ব্যাংকটিরই কিছু কর্মকর্তা ও বিভিন্ন সময়ে পর্ষদে থাকা পরিচালকরাও। বর্তমানে ব্যাংকটি তারল্য সংকটে ভুগছে। দৈনিক ১৮-২০ হাজার কোটি টাকা ধার করে চলছে। সম্প্রতি সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ২০ হাজার কোটি টাকার তারল্য সহায়তা চেয়েও চিঠি দিয়েছে ব্যাংকটি।

জনতা ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বরে ব্যাংকটির আমানত দাঁড়ায় ১ লাখ ১১ হাজার ৬৪২ কোটি টাকা ও ঋণ ৯৮ হাজার ৫৩৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ছিল ৬০ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৬১.৩৯ শতাংশ। সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটির নিট লোকসান দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৪৭৪ কোটি টাকা; প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩৯ হাজার ৮৬ কোটি টাকা। ফলে গত সেপ্টেম্বরে জনতা ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি বেড়ে ৩৩ হাজার ৯২১ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। ব্যাংকটির প্রাক্কলন অনুযায়ী, চলতি ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হবে ৬৮ হাজার কোটি টাকা। তাতে বছর শেষে লোকসান দাঁড়াবে ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা।

ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মজিবর রহমান বলেন, বেক্সিমকোর ঋণ এখনও দেওয়া হয়নি। মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক যে নির্দেশনা দিয়েছে সেই অনুযায়ী কাজ চলছে। আর তারল্য সংকটে যে ধার চাওয়া হয়েছে তা বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যালোচনায় রয়েছে। সহায়তা পেতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।

শেয়ার দিয়ে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন...