ঋণ বিতরণসহ পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম শুরু করতে কাজ করছে পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড (পিএলএফএসএল)। এরই অংশ হিসেবে নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ দিয়েছে। ভালো নিরাপদ বিনিয়োগের জায়গা পেলে ঋণ বা অর্থায়ন শুরু করতে চায় প্রতিষ্ঠানটি। বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ও পিপলস লিজিং সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্রমতে, প্রায় এক বছর ধরে কোম্পানির এমডির পদ শূন্য ছিল। ফলে কার্যক্রম অনেকটাই স্থবির থাকে। কর্মকর্তারা অফিস করলেও তেমন কোনো কাজ ছিল না। গত ১১ মে পিপলস লিজিংয়ের নতুন এমডি সগীর হোসেন খান দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। এখন তারা নিরাপদ বিনিয়োগ প্রস্তাব খুঁজছেন। ঋণ বিতরণ করলে ফেরত পাওয়া যাবে এবং ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত সম্পদ বন্ধক দেবে এমন জায়গা খুঁজছে।
জানা গেছে, বর্তমানে পিপলস লিজিংয়ের হাতে কম-বেশি একশ’ কোটি টাকার মতো নগদ অর্থ রয়েছে। প্রতিমাসে পুরনো ঋণ থেকে দুই থেকে নয় কোটি টাকার মতো আদায় হয়। কিন্তু নতুন বিনিয়োগ না থাকায় সেই টাকা থেকেই কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন, বোর্ড সদস্যদের সম্মানী, আইনি খরচ ও ইউটিলিটি বিল দিতে হচ্ছে।
ফকিরাপুলের বক্স কালভার্ট রোডের প্যারামাউন্ট হাইটসে তাদের নিজস্ব অফিস থাকায় কোনো ভাড়া দিতে হয় না। নতুন করে শাখা না বাড়িয়ে প্রধান কার্যালয় থেকেই ব্যবসা পরিচালনার কথা চিন্তা করছে। এতে কোম্পানির জনবল ও ভাড়া বাবদ খরচ কমবে।
এ ছাড়া মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে কিছু আমানতকারীদের টাকাও ফেরত দেওয়ার নির্দেশ রয়েছে আদালতের। ফলে এই জমাকৃত টাকা থেকেই আমানতকারীদের ফেরত দেওয়া হচ্ছে। এ পর্যন্ত প্রায় ৩০ কোটি টাকা আমানতকারীদের পরিশোধ করা হয়েছে। বর্তমানে শুধু খরচই হচ্ছে কোনো আয় আসছে না। যে কারণে নতুন ব্যবসা না করতে পারলে প্রতিষ্ঠানটি আরও চাপের মুখে পড়বে।
জানা গেছে, প্রায় ৬ হাজার আমানতকারীর কাছে পিপলস লিজিংয়ের দায় রয়েছে। মোট দায়ের পরিমাণ ও বিনিয়োগ বা ঋণ বাবদ গ্রাহকের কাছে পাওনা কত তা এখনো নিশ্চিত করতে পারেনি। ২০১৮ সালের পর আর কোনো পূর্ণাঙ্গ অডিট না হওয়ায় সঠিক পরিমাণ বলা যাচ্ছে না। শিগগিরই হালনাগাদ পূর্ণাঙ্গ অডিট হবে বলে জানায় কোম্পানি সূত্র।
নতুন এমডি সগীর হোসেন খান দায়িত্ব গ্রহণের আগে তিনি বাংলাদেশ ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফাইন্যান্স ফান্ড লিমিটেডের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকার্স রিক্রুটমেন্ট কমিটির নিয়োগের মাধ্যমে সিনিয়র অফিসার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
পিপলস লিজিংয়ের পর্ষদ সচিব মো. অর্মিয়া ফকির যায়যায়দিনকে বলেন, নতুন বিনিয়োগে যাওয়ার বিষয়টি কোর্টের নির্দেশনায় রয়েছে। সুতরাং যদি নিরাপদ বিনিয়োগের ক্ষেত্র পাওয়া যায় তাহলে পর্ষদ সে বিষয়টি ভেবে দেখবে। দীর্ঘদিন ব্যবস্থাপনা পরিচালক না থাকায় সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না। যেহেতু আদালতের নির্দেশনায় এটি রয়েছে, তাই এখন পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম শুরু করা যাবে বলে মনে করেন তিনি।
পুঁজিবাজারে আর্থিক খাতে তালিকাভুক্ত কোম্পানি পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিসের শেয়ার লেনদেন বন্ধের মেয়াদ ৮৭ দফায় বাড়ানো হয়েছে। ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদ কোম্পানির শেয়ার লেনদেন গত ১৪ থেকে ২৯ মে পর্যন্ত বন্ধ রেখেছে। প্রথম দফায় ২০১৯ সালের ১৩ থেকে ২৭ আগস্ট পর্যন্ত এ কোম্পানির শেয়ার লেনদেন বন্ধ রাখা হয়েছিল। এরপর ১৫ দিন পরপর কোম্পানির শেয়ার লেনদেন বন্ধের মেয়াদ বাড়িয়ে যাচ্ছে। এতে এ কোম্পানিতে আটকে থাকা বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ অনিশ্চয়তায় পড়েছে। ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের প্রতিটি শেয়ার সর্বশেষ ৩ টাকা বিক্রি হয়েছিল।
জানা গেছে, শীর্ষ ৫ জন খেলাপির কাছ থেকে অর্থ তোলা গেলে ক্ষুদ্র এবং মাঝারি পর্যায়ের গ্রাহকদের আমানত পরিশোধ করা যাবে। শীর্ষ ২ জন খেলাপির কাছ থেকে অন্তত ৫০০ কোটি টাকা আদায় করা সম্ভব।
২০২১ সালের জুলাই মাসে ব্যক্তি আমানতকারী, ফার্ম ও প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের মালিক-পরিচালকসহ সবার আবেদনে পিএলএফএস কোম্পানিকে পূনর্গঠন করার জন্য আদেশ দিয়েছেন এবং কোম্পানির বোর্ড গঠন করে দিয়েছেন।
এর আগে পিপলস লিজিংয়ের আমানতকারীরা একে অবসায়ন না করে পুনর্গঠন করার জন্য আদালতে আবেদন করেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৮ জুন এ আদালত পিপলস লিজিংয়ের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত জানিয়েছিলেন। এর আলোকেই নতুন পর্ষদ গঠন করেন হাইকোর্ট।
পিপলস লিজিংয়ের আর্থিক অবস্থা খারাপ হলে এটি অবসায়নের লক্ষ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মতি চায় বাংলাদেশ ব্যাংক। তাদের সম্মতি পেলে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৯ সালের জুলাইয়ে সাময়িক অবসায়ক (প্রবেশনাল লিকুইডেটর) হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান খানকে নিয়োগ করে। তার করা আবেদনের ওপর শুনানিকালে পিপলস লিজিংয়ের প্রায় ৫০০ জনের বেশি ঋণগ্রহীতার একটি তালিকা হাইকোর্টে দাখিল করা হয়। এরপর পাঁচ লাখ টাকা এবং তার ওপর নেওয়া ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে যারা খেলাপি হয়েছেন, এমন ২৮০ জনকে তলব করেন হাইকোর্ট। তাদের হাজির হয়ে ঋণ গ্রহণের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় ২১ জুন ২০১ জন আমানতকারী প্রতিষ্ঠানটি অবসায়ন না করে পুনরুজ্জীবিত করার নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেন। এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট নতুন পরিচালনা পর্ষদ নিয়োগ দিলেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানটিকে অবসায়ন না করে পুনর্গঠন করার পক্ষে মত দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটিকে অবসায়ন করা হলে এর আমানতকারীদের মধ্যে অর্থ ফেরত না পাওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হবে। এতে আর্থিক খাতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সেই বিবেচনায় আর্থিক খাতের সংশ্লিষ্টরাও একে অবসায়ন না করে পুনর্গঠন করার পক্ষে মত দেন।
এ প্রতিষ্ঠান থেকে ১ হাজার ১৩১ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৭৪৮ কোটি টাকা এখন খেলাপি। খেলাপি ঋণের মধ্যে ৫৭০ কোটি টাকা প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকরা প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছেন। এর মধ্যে পিকে হালদারের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর নামেই নেওয়া হয়েছে ৫০০ কোটি টাকার বেশি।
এদিকে আমানতকারীদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, টার্ম ডিপোজিট রিসিপ্ট (টিডিআর) নবায়ন করে ২০১৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত মুনাফা প্রদান করা।
সূত্র – যায়যায়দিন