বিগত সরকারের আমলে দেশের ব্যাংক খাত দখল করে মানুষের আমনতের টাকা উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। এর ফলে কিছু ব্যাংকে এখন গ্রাহকরা টাকা পাচ্ছেন না। এতে খাতটিতে চলচে ব্যাপক অস্থিরতা। দেশের আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংক গ্যারান্টির দিয়ে সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোকে টাকা ধার দিচ্ছে। এরপরেও তারল্য সহায়তা পাওয়া ব্যাংকগুলোর সংকট কাটছে না।
এমন পরিস্থিতির মধ্যে সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোতে তারল্য সহায়তা অব্যাহত রাখবে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এদিকে খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তারল্য সংকটের পাশাপাশি ব্যাংকগুলোতে আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে। ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণের কারণে পুরো খাতেই অস্বস্তি দেখা দিয়েছে। ব্যাংকগুলোতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ও আস্থার সংকট নিরসনে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে গ্যারান্টির মাধ্যমে ১০টি ব্যাংক থেকে ৭টি ব্যাংককে ৬ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা তারল্য সহায়তা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, এ সহায়তা দেওয়া হয় মূলত বাজারে তারল্য সংকট নিরসন এবং ব্যাংকগুলোর মধ্যে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে।
তবে এই সহায়তার পরেও ব্যাংকগুলোতে অর্থের ঘাটতি কাটছে না। এর কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাংক খাতে আস্থার সংকট একদিনে তৈরি হয়নি। বিগত সরকারের আমলে এ খাতে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। ব্যাংক খাত থেকে বের করে নেওয়া টাকার অধিকাংশ বিদেশে পাচার হয়ে গেছে।
আস্থা সংকটের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা বলছেন, গ্রাহকরা দেখছে যে বাংলাদেশ ব্যাংক পাশে রয়েছে। আবার এটাও দেখছে যে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাহায্য নিয়েও ব্যাংকগুলো পারছে না। তবে এসব বিষয়গুলো গ্রাহকরা মেনে নিয়েছে। কোনো এক সময় ব্যাংক খাতের এ সংকট ঠিক হয়ে যাবে বলেও গ্রাহকদের মধ্যে আশা রয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের আলাদা কর্মপরিকল্পনা অবশ্যই রয়েছে।
ব্যাংক খাতের তারল্যে সংকটের মধ্যেই বেড়েছে খেলাপি ঋণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ১৬ লাখ ৮২ হাজার ৮২১ কোটি টাকার ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, খেলাপি ঋণ ব্যাংক খাতের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের ব্যাংকিং খাতে মোট ঋণের প্রায় ১৭ শতাংশ এখন খেলাপি ঋণ। বিশেষ করে বেসরকারি ব্যাংকগুলো এই সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, সেপ্টেম্বর শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৬ হাজার ১১১ কোটি টাকা, যা তাদের বিতরণ করা ঋণের ৪০ দশমিক ৩৫ শতাংশ। অন্যদিকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪৯ হাজার ৮০৬ কোটি টাকা, যা তাদের বিতরণ করা ঋণের ১১ দশমিক ৮৮ শতাংশ। বিদেশি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা বা বিতরণ করা ঋণের ৪ দশমিক ৯৯ শতাংশ এবং বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫ হাজার ৮১৩ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র বলেন, ইতিমধ্যে তারল্য সংকটে থাকা ব্যাংকগুলো ঋণ সুবিধার মাধ্যে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। সবল ব্যাংক টাকা দেওয়ায় দুর্বল ব্যাংক উপকৃত হচ্ছে। তবে যে পরিমাণ তারল্য চাপ রয়েছে তা এই পরিমাণ সহায়তা দিয়ে পূরণ হচ্ছে না, যা বাংলাদেশ ব্যাংকও অবগত রয়েছে। তবে এই তারল্য সহায়তা অব্যাহত থাকবে। একইসঙ্গে দুর্বল ব্যাংকগুলোর নিজস্ব একটি রোডম্যাপ করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে ব্যাংকে গ্রাহকের চাপ কিছুটা কমেছে। গ্রাহকের স্বাভাবিক চাপ থাকলে এই তারল্য সহায়তা দিয়েও সংকট মোকাবেলা সম্ভব হবে। অতিরিক্ত গ্রাহক চাহিদা মেটাতে গিয়ে ব্যাংকগুলোকে চাপের মধ্যে পড়তে হচ্ছে। ব্যাংকগুলোকে নিজেদের সম্পদের জোগান নিজেদের করতে হবে। একইসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের তারল্য সহায়তা অব্যাহত থাকবে।
বর্তমান গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব নেয়ার পর দেশের ১১টি বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয়া হয়। ওই ব্যাংকগুলোতেই এখন তারল্য সংকট চলছে। অনিয়ম-দুর্নীতি হওয়ার পরও কিছু ব্যাংকের পর্ষদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, প্রাথমিকভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১১টি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দিয়ে নতুন পর্ষদ গঠন করেছে। পর্যায়ক্রমে দেশের সব ব্যাংকের বিষয়েই সিদ্ধান্ত আসবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে সব ব্যাংকে নিরীক্ষা চলছে। এ প্রক্রিয়া শেষে যেসব ব্যাংকে অনিয়ম-দুর্নীতি পাওয়া যাবে, তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়া হবে।