নভেম্বর ৮, ২০২৪

ব্রাসেলসভিত্তিক ইউরোপীয় অনলাইন নিউজ প্ল্যাটফর্ম ইইউ রিপোর্টার অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিষয়ে সাম্প্রতিক খোলা চিঠিতে স্বাক্ষরকারীদের সমালোচনা করে আজ একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছে।

নিবন্ধতে বলা হয়েছে যে, এটি একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কাজ যার উদ্দেশ্য হচ্ছে শুধু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই নয় বরং তিনি যে দেশটি শাসন করছেন সেটিরও অবমাননা করা। লন্ডনভিত্তিক সাংবাদিক, লেখক এবং রাজনীতি ও কূটনীতি বিশ্লেষক সৈয়দ বদরুল আহসান “বাংলাদেশ ব্যানানা (কলা) প্রজাতন্ত্র নয়” শিরোনামে নিবন্ধটি লিখেছেন।

নিচে নিবন্ধটি তুলে ধরা হলো:
যখন ১৭০-এর বেশি বৈশ্বিক ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটি খোলা চিঠি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং একই সাথে এটি সংবাদপত্রে একটি বিজ্ঞাপন হিসাবে প্রচার করেছিলেন, তখন তারা অনুধাবন করতে পারেননি যে, এই ধরনের কাজটি ছিল উদ্দেশ্য প্রণোদিত যা শুধু বাংলাদেশের নেত্রীই নয় বরং তিনি যে দেশটি শাসন করছেন সেটিকেও অবমাননা করার লক্ষ্যে এই পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। চিঠিতে ব্যবহৃত ভাষাও এমন ভাষা নয় যা সরকার প্রধানকে সম্বোধন করার জন্য প্রযোজ্য।

আমরা নোবেল বিজয়ীদের ও সেইসাথে অন্যদের কথা বলি যারা সম্প্রতি অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষে কথা বলা উপযুক্ত বলে মনে করেছেন, যিনি সম্প্রতি বাংলাদেশে আইনি জটিলতায় নিমজ্জিত হয়েছেন। প্রফেসর ইউনূস ২০০৬ সালে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার লাভ করেছেন। বাংলাদেশে তিনি ব্যাপকভাবে সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে ক্ষুদ্রঋণ জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে তার অবদান বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে উল্লেখযোগ্য ল্যান্ডমার্ক হিসেবে বিবেচিত।

১৭০ জনের বেশি ব্যক্তির চিঠিতে তাকে সমর্থনের বিষয়টি উদ্বেগজনক এই কারণে যে, এই ব্যক্তিরা তাদের চিঠির মাধ্যমে শেখ হাসিনার সরকারকে এমনভাবে চাপে রাখতে চেয়েছিলেন যা কেবল অপ্রীতিকর নয় বরং কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক শিষ্টাচার পরিপন্থী। প্রকৃতপক্ষে, চিঠির বিষয়বস্তু যা সুস্পষ্ট করেছে, তা কেবল দু:খজনকই নয়, বরং আপত্তিকরও। যিনি তার আর্থিক বিষয় সংশ্লিষ্ট কিছু আইনি সমস্যার জন্য লড়াই করছেন এমন একজন ব্যক্তিকে রক্ষা করার বিষয়ে কথা বলে চিঠির লেখকরা একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর মর্যাদা ক্ষুন্ন করেছেন।

অধ্যাপক ইউনূসের বিরুদ্ধে চলমান আদালতের কার্যক্রম অবিলম্বে স্থগিত করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আবেদন জানিয়েছেন চিঠির লেখকরা। তারা পরামর্শ দিয়েছেন যে, তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলি নিরপেক্ষ বিচারকের একটি প্যানেল দ্বারা পর্যালোচনা করা হোক। তারা আরও জানিয়েছে যে, সুবিচারের জন্য পর্যালোচনার অংশ হিসাবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কিছু বিশেষজ্ঞকে বিচারের বোর্ডে আনা উচিত। তারা প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে আরো বলেছেন,

‘আমরা নিশ্চিত যে (ইউনূসের) বিরুদ্ধে দুর্নীতিবিরোধী ও শ্রম আইনের মামলাগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনার ফলে তিনি খালাস পেয়ে যাবেন।’

সকলকে অবাক করে দিয়ে তারা বাংলাদেশের নেত্রীকে হুঁশিয়ার করে বলেছে, ‘আগামী দিনগুলিতে কীভাবে এই বিষয়গুলি সমাধান করা হবে তা নিবিড়ভাবে ট্র্যাক করার জন্য আমরা বিশ্বের লক্ষ লক্ষ উদ্বিগ্ন নাগরিকের সাথে যোগ দেব।’

চিঠির লেখকরা সম্ভবত এই পয়েন্টটি মিস করেছেন, সেটি হল যে একবার আইনের আদালতে একটি মামলা দায়ের করা হলে, যৌক্তিক উপসংহারে পৌঁছার জন্যই সম্পূর্ণ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। বিশ্বের কোথাও এমন কোনো আইনি ব্যবস্থা নেই যেখানে একটি মামলা, একবার এটি আদালতে শুরু হলে, কার্যক্রম থেকে অপসারণ করা এবং একটি ‘নিরপেক্ষ বিচারকদের প্যানেল’-এর কাছে হস্তান্তর করা যেতে পারে। কারণ এটি হবে আইনের সঙ্গে প্রতারণা। এছাড়াও, একটি দেশের স্বাভাবিক আইনে পরিচালিত একটি মামলা স্থগিত করা এবং এর বিবরণ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিশেষজ্ঞদের কাছে পর্যালোচনার জন্য হস্তান্তর করার বিষয়টিও বোধগম্য নয়।

চিঠিটি, একাধিক উপায়ে, বাংলাদেশ সরকারকে ঘায়েল করার একটি অপপ্রয়াস এবং বাংলাদেশের জনগণকে একদল লোকের সামনে নতজানু করার প্রয়াস, যারা প্রফেসর ইউনূসের কল্যাণের কথা মনে রেখেছেন কিন্তু তারা দেশটির সরকারের ওপর তাদের মতামত চাপিয়ে দেয়ার জন্য তাদের অধিকার সম্পর্কে অহংকার প্রকাশ করেছেন। এটা আইনের শাসন থেকে বিচ্যুতি। চিঠির লেখকরা অধ্যাপক ইউনূসের সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলি ট্র্যাক করার কথা বলেছেন, যা বাস্তবে সরকারের জন্য একটি হুমকি। তারা দাবি করে যে তারা তাই করবে ইচ্ছামতো যা তারা করতে চাইবে…

নোবেল বিজয়ী ও অন্যরা যারা চিঠিতে তাদের স্বাক্ষর রেখেছেন তারা স্পষ্টতই ইউনূসের বিষয় ছাড়াও অন্যান্য বিষয় দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে যা এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সরকার ও জনগণ সকলের সন্তুষ্টির জন্য করার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশের আসন্ন সাধারণ নির্বাচনের প্রশ্নে প্রফেসর ইউনূসের রক্ষার বিষয় থেকে চিঠির লেখকরা সরে গেছেন। তাদের কথাগুলো লক্ষ্য করুন- ‘আমরা বিশ্বাস করি আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়া সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।…’

অসঙ্গতির বিষয়ে ভুল করা উচিত নয়। চিঠির পেছনের উদ্দেশ্যটি অনুধাবন করা কঠিন নয়। বাংলাদেশে আগামী বছরের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য নির্ধারিত নির্বাচনের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারকে পথ দেখানোর বিষয়টি নিশ্চিত করার একটি স্পষ্ট উদ্দেশ্য এতে রয়েছে। হঠাৎ করে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করার ধারণাটি উঠে আসেনি যা বর্তমান ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা থেকে ঠেলে দেবে বলে মনে হচ্ছে। চিঠির লেখকরা কেন ইউনূস মামলার সঙ্গে নির্বাচনের যোগসূত্র বেছে নিয়েছেন সেটি একটি উদ্বেগজনক প্রশ্ন। স্বচ্ছতা ও রাজনৈতিক বিচক্ষণতা স্পষ্টতই কাজ করেনি। কাউকে অবাক করবে না যে, যারা এই চিঠিটি লিখেছেন এমন অনেক নারী ও পুরুষ বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের প্রতি তাদের অপছন্দ কখনও গোপন করেননি।

এটা দুঃখজনক, যারা চিঠিটি পড়েছেন তাদের জন্য নয়, চিঠির লেখকদের জন্য। বাংলাদেশ সরকারের এমন প্রকাশ্য নিন্দা যে পাল্টা প্রতিক্রিয়ার কারণ হবে তা বুঝতে তাদের ব্যর্থতা দুঃখজনক। চিরকালই তাদের ঐতিহ্যের জন্য গর্বিত একটি জাতি এই বাংলাদেশের জনগণ চিঠির মনোভাব ও বিষয়বস্তু দেখে হতবাক। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, এই চিঠি লেখকরা অতীতে বিশ্বজুড়ে জনসাধারণের মনোভাব সম্পর্কে অন্যান্য সরকার প্রধানদের কাছে একই ধরনের খোলা চিঠি পাঠিয়েছেন কিনা তা নিয়ে দেশে প্রশ্ন উঠছে। এই প্রশ্নগুলোর লক্ষ্য বিবেচনা করুন:

কয়েক দশক ধরে গুয়ানতানামোতে বিনা বিচারে আটকে থাকা এবং কারাবন্দিদের মুক্তি দেওয়ার দাবি জানিয়ে এই বৈশ্বিক ব্যক্তিত্বরা কি কখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো রাষ্ট্রপতির কাছে একটি খোলা চিঠি লিখেছেন?

কোন কারণ ছাড়াই ২০০৩ সালে স্বাধীন দেশ ইরাক আক্রমণ থেকে বিরত থাকতে এবং দেশটির প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে বিচারের নামে প্রহসন করে যখন ফাঁসি দেয়া হয়েছিল এই বিশিষ্ঠ ব্যক্তিরা কি তখন মার্কিন রাষ্ট্রপতি এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে কোন চিঠি লিখেছিলেন?

এই চিঠি লেখকরা কি পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে হয়রানি বন্ধে, তার বিরুদ্ধে ১৫০টির বেশি মামলা প্রত্যাহার এবং তার মুক্তির দাবিতে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের কাছে একটি উন্মুক্ত বার্তা পাঠানোর প্রয়োজন মনে করেছেন?

চিঠির লেখকরা নিজেদেরকে আইনের শাসনে বিশ্বাসী বলে মনে করে। তবে তারা কি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাদের বর্বর ভূমিকার কথা জেনেও কখনও বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত দুই খুনিকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে মার্কিন ও কানাডিয়ান কর্তৃপক্ষের কাছে লিখেছে।

২০০১ সালের অক্টোবরে সাধারণ নির্বাচনে জয়ের পরপরই আওয়ামী লীগ সমর্থক এবং সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর জোট সমর্থকরা যে তাণ্ডব চালিয়েছিল, তখন এর বিচার চেয়ে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কাছে এই ধরনের কোন চিঠি পাঠানো হয়েছিল?

এই ব্যক্তিবর্গ কি রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনের কাছে একটি খোলা চিঠি পাঠিয়েছেন এবং এটিকে পশ্চিমা সংবাদপত্রে একটি বিজ্ঞাপন হিসাবে প্রচার করে দাবি করেছেন যে আলেক্সি নাভালনির বিরুদ্ধে সমস্ত আইনি প্রক্রিয়া বাদ দিতে হবে এবং তাকে মুক্তি দিতে হবে?

এই চিঠি লেখকরা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ পর্বে কোথায় ছিলেন? তারা কি যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন কর্তৃপক্ষের কাছে কোন খোলা চিঠি লিখেছেন যে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার স্বার্থে অ্যাসাঞ্জকে তার পেশা চালিয়ে যাওয়ার জন্য মুক্তি দিতে হবে?

এই চিঠির লেখকদের মধ্যে কতজন মিয়ানমারের সামরিক জান্তার কাছে বন্দি অং সান সুচির বিরুদ্ধে সমস্ত অভিযোগ প্রত্যাহার এবং মিয়ানমারের নির্বাচিত নেতা হিসাবে তাকে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন? মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের লক্ষ লক্ষ শরণার্থীকে বাংলাদেশ মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়েছে। তাদের কবে দেশ ফিরিয়ে নেয়া হবে সে বিষয়ে এসব ব্যক্তি কি মিয়ানমারের জান্তার কাছে জানতে চেয়েছেন?

মিশরে সাংবাদিকরা বছরের পর বছর ধরে সে দেশের কারাগারে বন্দি। রাষ্ট্রপতি আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির কাছে কি তাদের মুক্তির জন্য কোন খোলা চিঠি লেখা হয়েছে?

কয়েক বছর আগে ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে খুন হন সাংবাদিক জামাল খাশোগি। এই নোবেল বিজয়ী এবং বৈশ্বিক নেতারা কি সৌদি সরকারকে চিঠি লিখে এই ট্রাজেডির সত্যতা তদন্ত করে দোষীদের শাস্তির দাবি জানিয়েছেন?

২০০৯ সালে সালে শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীর হাতে এলটিটিই-এর পরাজয়ের পর তামিল সংখ্যালঘুদের উপর যে অত্যাচার হয়েছিল এবং তামিলদের দুঃখ-দুর্দশার জন্য দায়ীদের বিচারের আওতায় আনার দাবিতে শ্রীলংকা কর্তৃপক্ষের কাছে কোনো খোলা চিঠি তো পাঠানো হয়নি।

সুষ্ঠু বিচারের জন্য ভন্ডামি কোন বিকল্প নয়। যেসব ব্যক্তি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে চিঠিটি লিখেছেন তারা স্পষ্টতই প্রফেসর ইউনূস সম্পর্কে তাদের উদ্বেগ সরকারকে বিচক্ষণ কূটনৈতিক উপায়ে জানাতে ব্যর্থ হয়েছেন। তারা যে ইচ্ছাকৃতভাবে বাংলাদেশের নোবেল বিজয়ীকে তাদের উদ্বেগ প্রকাশের জন্য বেছে নিয়েছেন এটি মূলত বাংলাদেশকে বিশ্বের সামনে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর একটি কৌশল।

একজন ব্যক্তির একটি ইস্যুতে বাংলাদেশ সরকারকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করার বিষয়ে কৌতূহলী হওয়া ও অনাকাক্সিক্ষত কাজটি নিজেদের কাঁধে তুলে নেয়ার চেয়ে বরং ১৭০-এর বেশি বৈশ্বিক ব্যক্তিত্বদের আরও ভাল কিছু চিন্তা করা উচিত ছিল। কৌশলটি সম্ভবত কাজ করেনি। খবর বাসস।

শেয়ার দিয়ে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন...