আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাত ধাপের প্রথম ধাপের ঋণ আগামী বছরের ফেব্রম্নয়ারিতে পাওয়া যাবে। তবে ঋণ পেতে বাংলাদেশকে পরিবর্তন করতে হচ্ছে ব্যাংক ব্যবস্থাপনার কাঠামো। সেই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পর্যবেক্ষণের জন্য স্থানীয়ভাবে নিজস্ব প্রতিনিধি রাখছে আইএমএফ। এদিকে শর্ত অনুযায়ী ব্যাংক পরিচালনায়ও আনতে হচ্ছে পরিবর্তন। ফলে ব্যাংক ব্যবস্থাপনার চিত্র পাল্টাবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
আইএমএফ বলেছে, চার বছর বা ৪২ মাসের জন্য তিনটি অ্যাকাউন্ট থেকে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেবে বাংলাদেশকে। ৩.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের এক্সটেন্ডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি (ইসিএফ) এবং এক্সটেন্ডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটি (ইএফএফ) এর অধীনে দেওয়া হবে। আর বাকি প্রায় ১.৩ বিলিয়ন ডলার রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটি (আরএসএফ) এর অধীনে। এতে গড় সুদের হার ২ দশমিক ২ শতাংশ হবে।
অর্থনীতিবিদবা বলছেন, ব্যাংক সেক্টরে সংস্কারের কথা আমরা অনেক আগে থেকে বলে আসছি। এখন সেটা আইএমএফের শর্তের মধ্যে পড়েছে। আমরা বলেছি, রাজস্ব আদায় বাড়াতে, ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে, খেলাপি ঋণ কমাতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে স্বায়ত্তশাসন দিতে। তবে দেরিতে হলেও এসব করতে আশ্বাস দিয়েছে সরকার; এটি একটি নতুন সূচনা।
তারা বলেন, আইএমএফ ঋণ পাওয়ায় অর্থনীতিতে যে চাপ সৃষ্টি হয়েছে, তা সামাল দেওয়া সহজ হবে। সরকারকে এই ঋণ সঠিকভাবে ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে তারা বলেছেন, এখন বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ অন্যরাও ঋণ নিয়ে এগিয়ে আসবে; সংকট কেটে যাবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, দুই সপ্তাহে দফায় দফায় ৫ বার পৃথকভাবে বৈঠক করেছে আইএমএফ। এর মধ্যে ১৭টি শর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে দরকষাকষি হয়েছে। শর্তগুলো মধ্যে হলো- রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একক কর্তৃত্ব স্থাপন করতে হবে, অর্থ পাচারকারীদের নাম ও বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করতে হবে, খেলাপি ঋণ কমাতে হবে, আয়কর বাড়াতে হবে, সরকারি ব্যয় কমাতে হবে, বেসরকারি কোনো ব্যাংকে এক পরিবারের দুইজনের বেশি পরিচালক থাকতে পারবে না, টানা ছয় বছরের বেশি পরিচালক থাকতে পারবে না কেউ, বাংলাদেশ ব্যাংকে থাকবে আইএমএফের পর্যবেক্ষক, সুদের হারের সীমা তুলে দিতে হবে, রিজার্ভের প্রকৃত পরিমাণ দেখাতে হবে, ব্যালেন্স অব পেমেন্টের সঠিক তথ্য প্রকাশ করতে হবে। ঋণ পেতে হলে পর্যায়ক্রমে এসব শর্ত পূরণ করতে হবে বাংলাদেশকে। এ সময় তাৎক্ষণিক তিনটি শর্ত মানতে রাজি হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিছু শর্ত পর্যায়ক্রমে মানার কথাও জানানো হয়। তবে কয়েকটি শর্ত মানার বিষয়ে কোনো ধরনের আশ্বাস দেয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দুটি বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন আইএমএফের প্রধান কার্যালয়ের কর্মকর্তারা।
গত দুই সপ্তাহে অনুষ্ঠিত বৈঠকে আইএমএফ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে আরও কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। এর মধ্যে রয়েছে, ঋণের সুদের হারের সীমা তুলে দেওয়া, অভিন্ন এক্সচেঞ্জ রেট, খেলাপি ঋণ কমানো, বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি কমিয়ে আনা, ব্যাংক পর্ষদ গঠনের আইনের সংস্কার, ব্যাংকের আইটি খাতের সংস্কার, বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা, খাতভিত্তিক আর্থিক ইন্ডিকেটরস, বিভিন্ন ব্যাংকের অনিয়মের বিরুদ্ধে গৃহীত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা, ১০টি দুর্বল ব্যাংকের জন্য নেওয়া উদ্যোগ, ফাইন্যান্সিয়াল সেক্টর সাপোর্ট প্রজেক্ট (এফএসএসপি) বাস্তবায়ন, ব্যাংক সুপারভিশন, ক্যাপাসিটি বিল্ডিং, ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১, ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন (সংশোধন) আইনসহ ৫টি অন্যতম আইনের সংস্কার।
এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর যায়যায়দিনকে বলেন, বাংলাদেশে অর্থনৈতিক যে চাপ সৃষ্টি হয়েছিল কিছুটা হলেও সেই চাপ থেকে সরকার স্বস্তি পাবে। বর্তমানে সরকার সাহস পাবে দেশের বিভিন্ন সংকট সঠিকভাবে মোকাবিলা করতে। এখন সরকারের কাজ হবে আইএমএফ ঠিক যে কারণে ঋণটা দিচ্ছে, সেটার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা। তিনি আরও বলেন, সরকারকে এখন আরও সতর্ক হতে হবে। আইএমএফের আস্থার জায়গাটা ধরে রাখতে হবে। অনেক কিছু যাচাই-বাছাই করে কিন্তু আইএমএফ ঋণটা দিতে রাজি হয়েছে। বাংলাদেশ বিদেশি যে কোনো ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে ভালো ভাবমূর্তি বজায় রেখেছে; কখনো কোনো ঋণ শোধের ক্ষেত্রে খেলাপি হয়নি। সেই আস্থা সরকারকে বজায় রাখতে হবে। তারা দেখেছে, নানা বাধা-বিপত্তির মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতি মোটামুটি একটা ভালো ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, আইএমএফ যখন দেখেছে, বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধ করার সামর্থ্য আছে, তখনই কিন্তু তারা ঋণটা দিতে রাজি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ডক্টর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ এ ঋণ পাওয়াতে বিভিন্ন দাতাসংস্থাগুলো দুয়ার আরও ভালোভাবে খুলে গেছে। এখন অন্যান্য দাতাসংস্থাগুলোর ঋণ পাওয়া সহজ হবে। এতে করে বাংলাদেশ যে অর্থনীতির সংকটে ভুগছিল তা দূর হবে। তিনি বলেন, গত কয়েক দিন বেশ আলোচনা হচ্ছে, সেটা হলো এই ঋণের জন্য অনেক শর্ত দিয়েছে আইএমএফ। আমার বক্তব্য হচ্ছে, আইএমএফ যে সব শর্তের কথা বলেছে, সেগুলো কিন্তু একটাও নতুন নয়। এই প্রত্যেকটা কথা আইএমএফ অনেক দিন ধরেই বলে আসছে। আমি এগুলোকে শর্ত বলতে চাই না; পরামর্শ বলব। আইএমএফ যে সব কথা বলছে, যেমন ধরুন, আইএমএফ আমাদের রাজস্ব আদায় বাড়াতে বলেছে, ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে বলেছে, খেলাপি ঋণ কমাতে বলেছে, বাংলাদেশ ব্যাংককে স্বায়ত্তশাসন দিতে বলেছে- এগুলো কিন্তু আমরাও বারবার বলে আসছি। আমরা দেশের ভালোর জন্য, মঙ্গলের জন্যই এ সব কথা বলেছি।
বৈঠকে উপস্থিত একাধিক সূত্র জানায়, রিজার্ভের দুটি বিষয় নিয়ে আপত্তি তুলেছে আইএমএফ। প্রথমত, রিজার্ভ হিসাব পদ্ধতিতে সংস্কার আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে রিজার্ভ থেকে বাদ দিতে হবে ইডিএফ (রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল) ও আইডিএফ (অবকাঠামো উন্নয়ন তহবিল)। প্রাথমিকভাবে এটি মানতে রাজি হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এক্ষেত্রে শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক পর্ষদ অনুমোদন নিলেই হবে। রিজার্ভ সংরক্ষণ পদ্ধতিতে আরও একটি আপত্তি তুলেছে আইএমএফ। তা হলো- রিজার্ভের যে মুনাফা হিসাবে বাংলাদেশ ব্যাংক দেখায় তার একটি অংশ আন-রিয়েলাইজড গেইন, সেটি বাদ দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আর্থিক বিবরণী মান (আইএফআরএস) অনুসরণ করা হয়নি। এ পদ্ধতি সংস্কারের শর্ত দেওয়া হয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, রিজার্ভের একটি অংশ স্বর্ণ ও বন্ডে বিনিয়োগ করে রেখেছে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের দাম বাড়লেই তা রিজার্ভের মুনাফা হিসেবে যোগ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে আইএফআরএস অনুযায়ী তা গ্রহণযোগ্য নয়। এক্ষেত্রে স্বর্ণ বিক্রি করে নগদায়ন করার আগে তাকে রিজার্ভের অংশ হিসেবে দেখানো যাবে না।