রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নির্দেশের পর ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি সারি সারি ট্যাংক, যুদ্ধাস্ত্র এবং সাঁজোয়া যান নিয়ে ইউক্রেনে ঢুকে পড়ে রুশ সেনারা। কাল শুক্রবার ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার এক বছর পূর্তি হবে।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে ইউক্রেনের চিত্র যেমন ছিল এক বছর পর সে চিত্র পুরোপুরি ভিন্ন। প্রেসিডেন্ট পুতিনের পরিকল্পনা অনুযায়ী গত বছর রাজধানী কিয়েভের অদূরে অবস্থিত হোস্তমেল বিমান ঘাঁটি দখল করার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালান রাশিয়ার এয়ারবোর্ন সদস্যরা। কিন্তু সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এরপর কয়েকদিন কিয়েভের কাছে অবস্থান করে রাশিয়ার ট্যাংকগুলো আবারও ফিরে যায়।
এক বছর পর যুদ্ধের পরিস্থিতি কী এবং পরবর্তীতে কী হবে সে বিষয়টি পর্যালোচনা করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান।
রাশিয়া কী নতুন অভিযান চালাচ্ছে?
ইউক্রেনে রুশ সেনাদের নতুন হামলা চালানোর সক্ষমতা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মত রয়েছে। যদিও ইউক্রেনের জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তারা গত বছরের ডিসেম্বর থেকেই সতর্কতা দিয়ে আসছিলেন— নতুন বছরে নতুন করে বড় হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে রাশিয়া। তবে ২০২২ সালে হামলা চালানোর আগে রুশ বাহিনীর যে ধরনের প্রস্তুতি ছিল, বর্তমানে সেরকম কিছু দেখা যাচ্ছে না।
যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রাশিয়া তাদের যুদ্ধবিমানগুলো জড়ো করছে। এছাড়া যুক্তরাজ্যও একই কথা বলেছে। বলা হচ্ছে, গত কয়েকদিনে সেনা সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে রাশিয়া। বর্তমানে ইউক্রেনে তাদের ৩ লাখ সেনা অবস্থান করছে। তবে গত বছরের মতো ইউক্রেনের অঞ্চলগুলোতে নেই সারি সারি যুদ্ধ ট্যাংক।
ন্যাটোর মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক সময়ে ইউক্রেনের পূর্ব দিকে হামলা জোরদার করেছে রুশ সেনারা। এটিই প্রমাণ করে ‘নতুন হামলা’ শুরু হয়েছে। তবে অনেকে বলছেন, যুদ্ধের শুরুর পর গত কয়েকমাসে রাশিয়া যে ধরনের হামলা চালিয়েছে এখন সে রকমই চলছে। উল্টো রুশ সেনাদের গোলাবর্ষণের মাত্রা কমেছে। গত গ্রীষ্মে এমনও সময় গেছে সেভেরেদোনেৎস্ক শহরে প্রতিদিন ৬০ হাজার বার গোলাবর্ষণ করেছে রুশ বাহিনী।
সেন্ট এন্ড্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্লেষক ফিলিপ ও’ব্রায়েন জানিয়েছেন, গত বছর নতুন করে অনেক মানুষকে সেনাবাহিনীতে যুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু তার মতে, তা সত্ত্বেও রাশিয়ান সেনাবাহিনীর ক্ষমতা কমেছে। তিনি বলেছেন, যারা ধারণা করছেন রাশিয়া গত বছরের মতো বড় হামলা চালাবে, তারা আসলে ভুলের মধ্যে আছেন।
তিনি আরও বলেছেন, ‘গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারির পর থেকে যা হয়েছে তা হলো ইউক্রেন শক্তিশালী হয়েছে এবং আরও আধুনিক অস্ত্র পেয়েছে, সামনে আরও পাবে। অপরদিকে রাশিয়ানরা দুর্বল হচ্ছে। তাদের এখন সেনার সংখ্যা অনেক বেশি কিন্তু তাদের যুদ্ধাস্ত্রের অবস্থা খারাপ, তাদের বর্তমান সেনারা আগের সেনাদের তেমন প্রশিক্ষিত না এবং তাদের অস্ত্র সরবরাহ কমছে।’
ও’ব্রায়েনসহ অন্যান্যরা বলছেন, আকাশ, নৌ ও সেনাদের সমন্বয়ে বড় জটিল অপারেশন চালানোর মতো সক্ষমতা রাশিয়ার রয়েছে— এমন প্রমাণ এখন কম।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সেনা সমাবেশের ঘোষণা দেওয়ার পর নতুন করে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন হাজার হাজার মানুষ
পূর্ব দিকে কী চলছে?
ইউক্রেনের পূর্ব দিকেই এখন মূল লড়াইটা হচ্ছে। রাশিয়ার সেনারা পূর্ব দিকে অবস্থিত দোনেৎস্কের বাখমুত শহর দখল করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছেন। মূলত ভবিষ্যত হামলার কথা চিন্তা করে বাখমুতের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করছেন তারা।
আরেকটি বিষয় হলো— রাশিয়া ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর পাল্টা আক্রমণের শঙ্কায় আছে, এ কারণে তারাই হামলার তীব্রতা বাড়িয়েছে— যে কোনো মূল্যে— ইউক্রেনের সেনাদের আটকে রাখার জন্য। আরেকটি বিষয় হলো, রাশিয়া ২৪ ফেব্রুয়ারির আগে বাখমুত দখল করার চেষ্টা চালিয়েছে প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর লক্ষ্যে। কার্যত কোনো অর্থপূর্ণ কারণ নেই।
তবে উপরে যেসব কারণ উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলোর সত্যতা হয়ত খুব কম। উল্লেখযোগ্য একটি বিষয় হলো, রুশ সেনারা শুধুমাত্র বাখমুতেই হামলা চালাচ্ছে না। তারা খারকিভের সীমান্ত থেকে শুরু করে দক্ষিণ দিকের দখলকৃত অঞ্চলগুলোর সম্মুখভাগেও নজর রাখছে। খুব সম্ভবত ইউক্রেনের সেনাদের দুর্বল অবস্থান খুঁজছে তারা।
যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ার রাশিয়ার বিষয়ক নৌ কেন্দ্রের বিশ্লেষক মাইকেল কোফম্যান এ বিষয়টি সম্প্রতি এক টুইটে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘রাশিয়ার হামলার লক্ষ্যবস্তু নির্দিষ্ট একটি দিক না, এর বদলে তাদের লক্ষ্যবস্তুতে রয়েছে ডনবাসের ৫-৬টি দিক। তারা উত্তর-দক্ষিণ লুহানস্ক থেকে বাখমুত এবং দক্ষিণ দোনেৎস্কের দিকে ছড়িয়ে অভিযান পরিচালনা করছে।’
‘বর্তমানে যা মনে হচ্ছে রাশিয়া তার রিজার্ভ সেনাদের ব্যবহার করেনি। যেসব ইউনিট বেশি হতাহত হয়েছে সেখানে হয়ত রিজার্ভ সেনাদের মোতায়েন করা হতে পারে— অথবা ব্রেকথ্রুর (সুযোগের) অপেক্ষা করছে।’
কিন্ত যে বিষয়টি পরিষ্কার সেটি হলো, গত এক বছরে রাশিয়ার বর্তমান নেতৃবৃন্দের দুর্বলতা, লজিস্টিক এবং কৌশলের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। সঙ্গে একেকটি অঞ্চল দখলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে তারা।
ইউক্রেনের পাল্টা হামলা?
গত বছরের গ্রীষ্মে খারকিভ এবং খেরসন প্রদেশে রুশ সেনাদের বিরুদ্ধে পাল্টা হামলা চালায় ইউক্রেনীয় সেনারা। যদিও তাদের পাল্টা হামলা প্রশমিত হয়ে এসেছে, কিন্তু এখনো খেরসন সিটির অপরপ্রান্তে অবস্থিত দানিপ্রো নদীতে কিছুটা সাফল্য পাচ্ছে তারা।
মস্কো আশঙ্কা করেছিল ইউক্রেনের সেনারা আরও হামলা চালাবে। বিশেষ করে জাপোরিঝিয়ার দিকে।
ইউক্রেনের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ প্রকাশ্যে জানিয়েছেন, তারা নিজেদের অঞ্চলগুলো থেকে রুশ সেনাদের হটিয়ে দিয়ে পুনরায় নিয়ন্ত্রণে নিতে চান। যার মধ্যে রয়েছে ক্রিমিয়া উপদ্বীপও। যেটি ২০১৪ সালে দখল করেছিল রাশিয়া। সাম্প্রতিক সময়ে কিয়েভ যেসব অস্ত্র ও সহায়তা পেয়েছে সেগুলোর মধ্যে ক্রিমিয়া পুর্নদখলের পরিকল্পনার বিষয়টিও আছে।
যে বিষয়টি পরিষ্কার সেটি হলো, ইউক্রেন পাল্টা হামলা চালানোরই প্রস্তুতি নিচ্ছে। এর অংশ হিসেবে সাঁজোয়া যান, দুরপাল্লার অস্ত্র, যুদ্ধ ট্যাংক জমা করছে দেশটি।
তবে এটি উল্লেখ করতে হয় যে, পশ্চিমা দেশগুলোই প্রশ্ন তুলেছে বাখমুতকে রক্ষা করা আবার একইসঙ্গে পাল্টা হামলা চালাতে পারবে কিনা ইউক্রেন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্ট একটি প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ইউক্রেনের সেনাদের জন্য একসঙ্গে বাখমুত অক্ষুন্ন রাখা আবার পাল্টা আক্রমণ চালানোর সম্ভাবনা ‘অবাস্তব।’
মূল লড়াইটা এখন হচ্ছে দোনেৎস্কের বাখমুতে। সেখানে অবস্থানরত রুশ সেনাদের লক্ষ্য করে কামান থেকে গোলা ছুড়ছেন দুই ইউক্রেনীয় সেনা
যুদ্ধে কে জয় পাচ্ছে?
যুদ্ধে কে জয় পাচ্ছে সেটি বিভিন্নভাবে মূল্যায়ন করা যায়। বর্তমানে রাশিয়া এবং ইউক্রেন কোনো পক্ষই তাদের লক্ষ্য অর্জন করতে পারছে না। ইউক্রেনের লক্ষ্য হলো দখলকৃত সব অঞ্চল পুনরুদ্ধার করা।
তবে গত বছর হামলা চালানোর আগে রাশিয়া যেসব লক্ষ্য ঠিক করেছিল, সেগুলোর বেশিরভাগ থেকে সরে এসেছে। যার মধ্যে রয়েছে ইউক্রেনের সরকারের পতন ঘটানো এবং সেখানে নিজেদের আজ্ঞাবহদের বসানো। এর বদলে এখন তারা নজর দিয়েছে পুরো ডনবাস দখল করবে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, রাশিয়া গত এক বছরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে। যুদ্ধবিষয়ক পর্যবেক্ষক একটি সংস্থা গত সপ্তাহে জানিয়েছে, ইউক্রেনে হামলা করার আগে রাশিয়ার যত ট্যাংক ছিল সেগুলোর মধ্যে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ ট্যাংক হারিয়েছে তারা। এছাড়া সেনাদের মধ্যে অনেক প্রাণহানীর ঘটনাও ঘটেছে। গত সপ্তাহে দাবি করা হয় পূর্ব দিকে ১০০ মিটার অঞ্চল দখল করতে ২ হাজার সেনা হারিয়েছে মস্কো। যদিও এ বিষয়টি বেশ সতর্কতার সঙ্গে দেখতে হবে। তবে রাশিয়ানদের তুলনায় ইউক্রেনীয় সেনারা কম ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে এটি সত্য।
যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় জেনারেল মার্ক মিলে কয়েকদিন আগে বলেছেন, রাশিয়া কৌশলগতভাবে ইতোমধ্যে হেরে গেছে। তবে তিনি সঙ্গে এও জানান, দুই পক্ষের কেউই এখনই তাদের লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে না।
এটি বলা যায়, যুদ্ধের বর্তমান গতিপথ ইউক্রেনের অনুকূলে রয়েছে। তারা পশ্চিমাদের অস্ত্র পাচ্ছে। এবং অব্যাহত অস্ত্র আসতে থাকলে এ গতিপথটি ইউক্রেনের পক্ষেই থাকবে।
কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি প্রধান জোসেপ বোরেল কয়েকদিন আগে সতর্কতা দিয়ে বলেছেন, ইউক্রেনে পশ্চিমা দেশগুলোর অস্ত্রের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। এমনকি কামানের জন্যও পশ্চিমাদের দিকে চেয়ে থাকে তারা। আর পশ্চিমাদের ওপর অতি নির্ভরতার কারণে পূর্ব দিকে ইউক্রেনের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। যেখানে মূলত কামানের লড়াই চলছে।
এখন যে বিষয়টি নিয়ে সবচেয়ে বেশি ভাবা হচ্ছে হচ্ছে সেটি হলো, পশ্চিমাদের দেওয়া ভারি ট্যাংক যুদ্ধে কতটা প্রভাব ফেলবে এবং কত দ্রুত এ যুদ্ধ শেষ করবে। কিন্তু বর্তমানে যুদ্ধ চলছে…।