ডিসেম্বরেও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় রাজস্ব আদায় করতে পারেনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় রাজস্ব আদায় কমেছে শূন্য দশমিক ৯৯ শতাংশ। আর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রাজস্ব আদায় কম হয়েছে প্রায় ৫৮ হাজার কোটি টাকা।
গত অর্থবছর একই সময় রাজস্ব আদায় হয়েছে প্রায় এক লাখ ৫৮ হাজার কোটি টাকা, যেখানে চলতি অর্থবছর ছয় মাসে আদায় হয়েছে প্রায় এক লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় এক শতাংশ কম রাজস্ব আদায় হয়েছে। এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, অস্বাভাবিক লক্ষ্যমাত্রার কারণে ঘাটতি বাড়ছে। এছাড়া জুলাই ও আগস্ট মাসে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, ডলারের মূল্য বৃদ্ধিসহ বেশ কয়েকটি কারণে আদায় কমে গেছে।
এনবিআরের গবেষণা ও পরিসংখ্যানের হিসাব অনুযায়ী, চলতি অর্থবছর এনবিআরকে লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়েছে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্থবছরের প্রথমার্ধের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ১৪ হাজার ১৪৩ কোটি ১০ লাখ টাকা; যার বিপরীতে আদায় হয়েছে এক লাখ ৫৬ হাজার ৪১৯ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ ছয় মাসে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৫৭ হাজার ৭২৩ কোটি ৬১ লাখ টাকা কম রাজস্ব আদায় হয়েছে। অন্যদিকে, গত অর্থবছর একই সময়ে রাজস্ব আদায় হয়েছে এক লাখ ৫৭ হাজার ৯৮৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা। অর্থাৎ গত অর্থবছরের তুলনায় এক হাজার ৫৬৯ কোটি ৪১ লাখ টাকা কম আদায় হয়েছে।
হিসাবে আরও দেখা গেছে, আয়কর, ভ্যাট ও কাস্টমসÑএই তিন খাতের মধ্যে ভ্যাটের প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক। তবে আয়কর ও কাস্টমস ঋণাত্মক না হলেও আয়করের চেয়ে কাস্টমস প্রবৃদ্ধিতে কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে। আয়কর খাতে ছয় মাসে চলতি অর্থবছর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭৬ হাজার ৬৭ কোটি ৭৫ লাখ টাকা; যার বিপরীতে আদায় হয়েছে ৫২ হাজার ১৬২ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। যেখানে গত অর্থবছর একই সময় আদায় হয়েছে ৫০ হাজার ৮৪৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা। আয়কর খাত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে না পারলেও প্রথমার্ধে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২ দশমিক ৫৯ শতাংশ। অপরদিকে, কাস্টমস খাতে প্রথমার্ধে ৬১ হাজার ৯৫২ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় হয়েছে ৪৯ হাজার ৮০ কোটি টাকা। যেখানে গত অর্থবছর একই সময় আদায় হয়েছে ৪৮ হাজার ৭৮৩ কোটি ৮ লাখ টাকা। এই খাতে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হলেও প্রবৃদ্ধি হয়েছে শূন্য দশমিক ৬১ শতাংশ। আর ভ্যাট খাতে ৭৬ হাজার ৩১৭ কোটি ৩৫ লাখ টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় হয়েছে ৫৫ হাজার ১৭৭ কোটি টাকা। তবে গত অর্থবছর একই সময় আদায় হয়েছে ৫৮ হাজার ৩৬০ কোটি ৪২ লাখ টাকা। অর্থাৎ ভ্যাট খাতে প্রথমার্ধে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাইনাস ৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ।
এনবিআরের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, চলতি অর্থবছর রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অস্বাভাবিক হারে বাড়ানো হয়েছে। ফলে আদায়ে প্রভাব পড়ছে। এছাড়া রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা যোগ হয়েছে। আবার বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, ডলারের মূল্য বৃদ্ধি, বড় প্রকল্পগুলোয় অর্থ ছাড় কমে যাওয়াসহ বেশ কয়েকটি কারণে আদায় কমে গেছে। চলতি অর্থবছর আইভাস থেকে রাজস্ব আদায়ের হিসাব নেয়া হচ্ছে। ফলে মাঠ পর্যায়ের কোন অফিসে বাড়তি কোনো রাজস্ব দেখানোর সুযোগ নেই। গত অক্টোবর থেকে রাজস্ব আদায়ে কিছুটা গতি বেড়েছে এবং সর্বশেষ ডিসেম্বরে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় আদায় বেড়েছে প্রায় ছয় শতাংশ। তা সত্ত্বেও চলতি অর্থবছরে রাজস্বে বড় ঘাটতি অপেক্ষা করছে বলে মনে করছেন তারা।
অপরদিকে, রাজস্ব আদায় বাড়ানোর জন্য ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড (আইএমএফ) সরকারকে ক্রমাগত চাপ দিয়ে যাচ্ছে, যার কারণে গত ৯ জানুয়ারি শতাধিক পণ্য ও সেবায় ব্যাপকহারে ভ্যাট বাড়িয়েছে সরকারÑযার মাধ্যমে বাড়তি প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যও রয়েছে। এছাড়া আয়কর বিভাগ বেশ কিছু এসআরও সুবিধা বাতিল করেছে। যেসব খাতে সুবিধা বাতিল করা হয়েছেÑসেসব খাত থেকে বাড়তি প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হবে মনে করছে এনবিআর। এই বিষয়ে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ বলেন, গত সরকারের সময়ে বাস্তবতা বিবেচনা না করেই বড় রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা নেয়া হয়েছিল, যার কারণে এখন প্রায় ৫৭ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। জুলাই, আগস্টের গণঅভ্যুত্থান এবং পরবর্তী সময় অর্থনীতিতে একটা ইমপ্যাক্ট তো পড়েছে। একদিকে ব্যবসায়ে গতি কম, অন্যদিকে মাঠ পর্যায়ের আদায়কারী অফিসগুলোর মধ্যেও গা-ছাড়া ভাব রয়েছে। এর ফলে রাজস্ব আদায়ে প্রত্যাশিত গতি না আসার অন্যতম কারণ। বকেয়া রাজস্ব আদায়, কর ফাঁকিবাজদের খুঁজে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর সুযোগ ছিল। কিন্তু এ ক্ষেত্রে হয়তো ততটুকু গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, আগামী মাসগুলোয় ডেভেলপমেন্ট পার্টনারদের অর্থছাড় বাড়তে পারে, তাতে অর্থনীতিতে গতি বাড়বে। তা সত্ত্বেও রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় বড় ঘাটতি হতে পারে। এ অবস্থায় রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করে কমিয়ে আনার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন তারা। একই সঙ্গে মাঠ পর্যায়ের অফিসগুলোর কর্মকর্তাদের আরও সক্রিয় হওয়ারও পরামর্শ তাদের।