নির্মম হত্যার মধ্য দিয়ে তাঁকে মুছে ফেলতে চাইলেও তিনি রয়ে গেছেন বাঙালির হৃদয় ও মননের সমস্ত সত্তাজুড়ে। তাই এখনো তাঁর জন্য বাঙালির হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। বাঙালির মানসপটে চির অমলিন হয়ে আছেন। যা বাংলা ও বাঙালির জন্য ছিল সর্বজনবিদিত।
হেনরি কিসিঞ্জারের সাবেক স্টাফ এ্যাসিস্ট্যান্ট রজার মরিস এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, মুজিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে কিসিঞ্জার তার ব্যক্তিগত পরাজয় বলে মনে করতেন। কিসিঞ্জারের বিদেশী শত্রুর তালিকায় সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তিরা হচ্ছেন- আলেন্দে, থিউ ও শেখ মুজিব। এ তিনজন তার বিভিন্ন পরিকল্পনা ভুল করে দেন। আমেরিকা ও তার অনুগ্রহভাজন পাকিস্তানকে সত্যিকারভাবে পরাজিত করে মুজিবের বিজয় ছিল আমেরিকার শাসকবর্গের পক্ষে অত্যন্ত বিব্রতকর। (বাংলাদেশ দি আনফিনিশড রেভ্যুলিউশন, লরেন্স লিফসুল)।
সত্যিই তো, তাদের সকল পরিকল্পনা ভণ্ডুল করে শোষণমুক্ত একটি সুন্দর সমাজ ব্যবস্থা বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখেছিলেন হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করে আমরা স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছি। তাঁর জন্ম না হলে আমরা বাংলায় খুুঁঁজে পেতাম না সার্বভৌম ঠিকানা। তিনি নিজের জীবন বাজি রেখে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। তিনি ছিলেন বাঙালি জাতির পথ প্রদর্শক, সমগ্র জাতির পুরোধা স¦রূপ। মাত্র নয় মাসে যুদ্ধের দামামা থামিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার পাওয়া অসম্ভবের নামান্তর।
অথচ, তাঁকে হত্যা করার মাধ্যমে একটি আধুুনিক, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল রাষ্ট্রের উত্থানকে চিরতরে থামিয়ে দেওয়াই ছিল মূল উদ্দেশ্য। সেজন্যই তাঁকে সপরিবারে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মধ্যরাতে হত্যা করা হয়। তাঁকে হত্যার মধ্য দিয়ে শুধুু একজন রাষ্ট্রনেতা নয়, বাংলাদেশ নিয়ে তাঁর আজীবনের স্বপ্নটিকেই হত্যা করতে তৎপর ছিল। নির্মম হত্যার মধ্য দিয়ে তাঁকে মুছে ফেলতে চাইলেও তিনি রয়ে গেছেন বাঙালির হৃদয় ও মননের সমস্ত সত্তা জুড়ে। তাই, এখনো তাঁর জন্য বাঙালির হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। বাঙালির মানসপটে চির অমলিন হয়ে আছেন। যা বাংলা ও বাঙালির জন্য ছিল সর্বজনবিদিত।
বিবিসিতে সাংবাদিক ডেভিড ফ্রন্ট তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আপনার সবচেয়ে বড় শক্তি কি? বঙ্গবন্ধু জবাব দিয়েছিলেন, ‘আমার জনগণ’। দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করলেন, আপনার সবচেয়ে বেশি দুর্বলতা কি? তখনো উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমার জনগণ’।
মূলত তিনি দেশের জনগণকে ভালোবেসেছেন মন থেকে। সেজন্যই পশ্চিম পাকিস্তানিদের শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন এবং সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ, নিপীড়ন এবং বঞ্চনার পাশাপাশি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিস্তারের প্রবণতা তাঁকে নানাভাবে আলোড়িত করেছিল। তখন থেকেই তিনি উপলব্ধি করেন দ্বিজাতিতত্ত্বের অসারতা। বাঙালি জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে জাতিকে পথ দেখানোর স্পৃহা তাঁকে সব সময়ই অনুপ্রাণিত করত। তিনি সব সময়ই আপামর জনসাধারণের চিন্তা চেতনা নিয়ে কাজ করতেন।
সেজন্যই বাংলার মানুষ তাঁকে অতি আপন করে কাছে নিয়েছিল। তাই, বাংলার মানুষ তাঁকে বঙ্গবন্ধু ডাকতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করত। নিজের শ্রেষ্ঠত্বের আসনে আসীন করতে পেরেছিলেন উনার যোগ্য নেতৃত্বের গুণাবলির জন্য। সদা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ থেকে সমগ্র জাতিকে রক্ষা করার প্রয়াসে লিপ্ত থেকেছেন। আমরা তাঁর জীবনী থেকে প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধ্যানধারণা খুঁজে পাই। তাঁর রচিত গ্রন্থ ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘আমার দেখা নয়া চীন’ এবং ‘কারাগারের রোজনামচা’ থেকে তাঁর আজন্মলালিত স্বপ্ন ও সাধনার বাংলাদেশের ছবিও আমাদের চোখের সামনে ফুটে ওঠে। তাঁর এই অর্জন সম্ভব হয়েছে তাঁর সারা জীবনের ত্যাগের বিনিময়ে।
বিশ্বের অন্য অনেক নেতার মতো তিনিও দেশের পরিচিতি বিস্তৃত করেছিলেন। তাঁর নাম উচ্চারণ না করে বাঙালির আত্মপরিচয় কখনো পূর্ণ হবে না। তাই, বাংলাদেশ সফরে এসে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর দেখার পর ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং মন্তব্য বইয়ে বঙ্গবন্ধুকে চিঠি লিখেন। তিনি লিখেন, ‘প্রিয় শেখ মুজিব, মানুষ বলে তুমি মৃত। কিন্তু আমি অনুভব করি তুমি আজও আমাদের চারপাশে। আমি খুশির সঙ্গে জানাতে চাই যে তোমার স্বপ্ন আজ তোমার মেয়ে শেখ হাসিনার দ্বারা পূরণ হয়েছে। তুমি বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের হৃদয় জয় করেছ। তুমি কেবল বঙ্গবন্ধু নও, ভুটানেরও বন্ধু।
বিখ্যাত সাংবাদিক সেরিল ডান বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলেছেন, ‘In the thousand years history of Bangladesh, Sheikh Mujib is the only leader hwo has, in terms of blood, race, language, culture and birth, been a full- blood Bengali.’
অথচ, ধূসর এ পৃথিবীতে এক সময় তিনি যাদের জন্য স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন এঁকেছিলেন, দেশকে ভালোবেসেছিলেন, তার প্রতিদানে সপরিবারে বলিদান দিতে হয়েছিল কতিপয় মানুষের নির্মম হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। পঁচাত্তরের সেই ১৫ আগস্টের শ্রাবণের রাতে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে তাঁর আদর্শকে বাঙালির জাতিসত্তা থেকে মুছে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তা কখনো সম্ভব হয়নি। অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনের বিমূর্ত প্রতীক হিসেবে বাঙালি জাতীয়তাবাদ পরিচয়কে সামনে নিয়ে এসেছিলেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতস্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষ দর্শনে সংবিধান প্রণয়ন করেছিলেন। তাই তাঁর রাজনীতি ও সংস্কৃতির দর্শন বাঙালিকে অনুপ্রাণিত করে, যা বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে।
লেখক: অন্জন কুমার রায়
ব্যাংক কর্মকর্তা