ভারতের উত্তর সিকিমে ভারী বর্ষণসহ উজান থেকে নেমে আসা ঢলে পানি বাড়ছে তিস্তা অববাহিকায়। চাপ সামলাতে ডালিয়া ব্যারেজ পয়েন্টে সবকটি জলকপাট খুলে দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। হু হু করে পানি ঢুকছে দুই পাড়ের চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলে। এতে করে বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে তিস্তার নিম্নাঞ্চলে।
এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র সূত্র জানিয়েছে, আগামী ২৪ হতে ৭২ ঘণ্টায় দেশের উত্তরাঞ্চল এবং তৎসংলগ্ন উজানে ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে। এর ফলে আগামী ৭২ ঘণ্টায় দেশের উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদীসমূহের পানি সমতল সময় বিশেষে দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে। এবং কতিপয় স্থানে বিপৎসীমা অতিক্রম করে সংলগ্ন নিম্নাঞ্চলে স্বল্পমেয়াদি বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে।
সূত্র আরও জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামে ১০২ দশমিক শূন্য মিলিমিটার এবং রংপুর-লালমনিরহাটের কাউনিয়া পয়েন্টে ৮০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। একই সময়ে ভারতের উজানে গ্যাংটক সিকিমে ৫০ দশমিক শূন্য মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।
তিস্তা নদী বেষ্টিত এলাকাগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উজানের ঢল আর গত কয়েক দিনের বৃষ্টির ফলে গত বৃহস্পতিবার (১৩ জুন) বিকেল থেকে ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তায় পানি বাড়তে থাকে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ব্যারেজের ৪৪টি গেটই খুলে রাখা হয়েছে। গতকাল শুক্রবার বিকেলের দিকে ডালিয়া পয়েন্টে পানি কিছুটা কমতে শুরু করলেও ভাটির দিকে রংপুর জেলার কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার কাছ দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে। ভারতে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি হলে উজান থেকে নেমে আসা ঢলে বাংলাদেশ প্রান্তে তিস্তা অববাহিকায় পানি আরও বাড়তে পারে।
এদিকে, তিস্তায় পানি বৃদ্ধির কারণে লালমনিরহাট সদর, জেলার পাটগ্রাম, হাতিবান্ধা, কালিগঞ্জ, আদিতমারী, নীলফামারীর ডিমলা, জলঢাকা, রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া, পীরগাছা, কুড়িগ্রামের রাজারহাট, উলিপুর এবং গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার তিস্তা অববাহিকার চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চল পানিতে নিমজ্জিত হচ্ছে। কিছু কিছু এলাকায় বাদাম, শাক-সবজিসহ বিভিন্ন ফসল পানিতে তলিয়েছে।
রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে, শনিবার (১৫ জুন) সন্ধ্যা ৬টার দিকে কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয়েছে ২৮ দশমিক ৫৩ সেন্টিমিটার। এর আগে এই পয়েন্টে সকাল ৬টায় পানির প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ২৮ দশমিক ৬০ সেন্টিমিটার, সকাল ৯টায় ২৮ দশমিক ৫৭ সেন্টিমিটার, দুপুর ১২টায় ২৮ দশমিক ৫৫ সেন্টিমিটার এবং বিকেল ৩টায় ২৮ দশমিক ৫৪ সেন্টিমিটার। তিস্তার কাউনিয়া পয়েন্টে বর্তমানে (সন্ধ্যা ৬টা) বিপৎসীমার শূন্য দশমিক ১৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এই পয়েন্টে বিপৎসীমা ২৮ দশমিক ৭৫ ধরা হয়।
অপরদিকে দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারেজের ডালিয়া পয়েন্টে সন্ধ্যা ছয়টায় পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫১ দশমিক ৪৮ সেন্টিমিটার, যা বিপৎসীমার শূন্য দশমিক ৬৭ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর আগে এই পয়েন্টে সকাল ৬টায় ৫১ দশমিক ৭৫ সেন্টিমিটার, সকাল ৯টায় ৫১ দশমিক ৬০ সেন্টিমিটার ও দুপুর ১২টায় ২৮ দশমিক ৪৬ সেন্টিমিটার এবং বিকেল ৩টায় ৫১ দশমিক ৫০ সেন্টিমিটার পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয়। এখানে ৫২ দশমিক ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হলে বিপৎসীমা অতিক্রম করে।
এদিকে কাউনিয়া উপজেলার বালাপাড়া ইউনিয়নের গদাই গ্রামের বাসিন্দা মজিরন নেছা জানান, গত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে নদীতে পানি বেড়ে যাওয়ায় ওই এলাকায় ভাঙন শুরু হয়েছে। তিস্তা তীরবর্তী কয়েকটি এলাকার গত দুই সপ্তাহে অন্তত ১৫-২০টি বসতঘর ও স্থাপনা নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে। পাশাপাশি হুমকিতে রয়েছে গদাইসহ আশপাশের তিন গ্রামের কয়েক শ বসতভিটা, স্কুল ও মসজিদ।
এই উপজেলার বালাপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনছার আলী বলেন, তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নদী তীরবর্তী ও চরাঞ্চলের মানুষদের মাঝে দুর্ভোগের আতঙ্ক রয়েছে। নদীর তীরবর্তী আবাদি জমিগুলো তলিয়ে গিয়ে বাদাম ও শাক-সবজিসহ উঠতি বিভিন্ন ফসলের ক্ষতি হবে। নদীর নিম্নাঞ্চল হালকা প্লাবিত হয়েছে। হঠাৎ পানি বাড়ার ফলে গবাদি পশুপাখি নিয়ে মানুষজন বিপাকে পড়ার আশঙ্কা করছেন। তবে এখন পর্যন্ত তেমন ক্ষয়ক্ষতি নেই বললেই চলে।
কাউনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মহিদুল হক বলেন, এখন পর্যন্ত বন্যার আভাস পাওয়া যায়নি। তবে উজানের ঢলে বন্যায় যাতে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে ব্যাপারে সরকারিভাবে সব ধরনের আগাম প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। সেই সাথে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সার্বক্ষণিক নদীপাড়ের মানুষের পরিস্থিতির খোঁজ-খবর রাখতে বলেছি। কোনো প্রকার ক্ষয়ক্ষতি হলে সরকারি ভাবে তাদের সহায়তা করা হবে।
গঙ্গাচড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাহিদ তামান্না জানান, এখনো প্লাবন পরিস্থিতি হয়নি। তবুও তারা সতর্ক রয়েছেন। নদীর চরাঞ্চলে বসবাস করা বাসিন্দাদের উঁচু জায়গায় গবাদি পশুসহ অন্যান্য সামগ্রী রাখার আহ্বান জানানো হয়েছে। তিনি বলেন, বন্যা হলে রেসকিউ করার জন্য টিম প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বলেন, উজানের ঢল আর গত কয়েকদিন ধরে বৃষ্টিপাতের কারণে ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তায় পানি বাড়তে শুরু করে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ব্যারেজের সবকটি গেটই খুলে রাখা হয়েছে। শনিবার বিকেলের দিকে ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি কিছুটা কমতে শুরু করেছে। তবে কাউনিয়া পয়েন্টে কিছুটা বাড়ছে পানি প্রবাহ। এছাড়া ভাটির অঞ্চলে সার্বক্ষণিক নদীপাড়ের পরিস্থিতির খোঁজখবর রাখা হচ্ছে।
রংপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোবাশ্বের হাসান বলেন, বন্যা মোকাবিলায় মাঠ পর্যায়ে উপজেলা প্রশাসনকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সম্ভাব্য সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছেন তারা। নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল ও চরে থাকা মানুষজনকে নিরাপদে থাকার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
রংপুর বিভাগীয় কমিশনার জাকির হোসেন বলেন, উজানের ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা, ঘাঘট, করতোয়া, ব্রহ্মপুত্রসহ সব নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত বন্যার আভাস পাওয়া যায়নি। তারপরও সরকারিভাবে সব ধরনের আগাম প্রস্তুতি নেয়া আছে, যাতে বন্যায় কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। প্রশাসনের পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা সাথে সার্বক্ষণিক নদীপাড়ের পরিস্থিতির খোঁজখবর রাখছেন।