রপ্তানি আয় বাড়াতে এবং দেশের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সহায়তার জন্য রপ্তানি পণ্যের বৈচিত্র্যকরণের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। তিনি মূল্য সংযোজিত তৈরি পোশাক, ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্য, প্লাস্টিক, চামড়া, পাটজাত পণ্য, জাহাজ নির্মাণ এবং দক্ষ জনশক্তিসহ কয়েকটি ক্ষেত্রের কথা উল্লেখ করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ থেকে আমসহ কৃষিপণ্য রপ্তানি বৃদ্ধির অনেক সম্ভাবনা রয়েছে।
তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও গত ১৫ বছরে অসাধারণ অগ্রগতি অর্জন করেছে বাংলাদেশ। ড. হাছান বলেন, এটা শুধু ম্যাজিক নয়। এটা সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাদুকরী নেতৃত্বের কারণে। বাংলাদেশ কীভাবে খাদ্যে স্বয়ংসম্পনান দেশে পরিণত হয়েছে এবং কীভাবে দারিদ্র্য মোকাবিলা করেছে তাও তিনি তুলে ধরেন।
বুধবার বিআইআইএসএস অডিটোরিয়ামে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) আয়োজিত 'অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য ও বৈশ্বিক বাজার: বাংলাদেশের সুযোগ ও উত্তরণের উপায়' শীর্ষক আন্তর্জাতিক সেমিনারে তিনি এসব কথা বলেন।
হাছান মাহমুদ বলেন, স্বাধীনতার পরে জিডিপিতে কৃষির অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। বর্তমানে কৃষির অবদান কমে এসেছে ৫ শতাংশে। বিপরীতভাবে শিল্পের অবদান ৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩৪ শতাংশ গিয়ে পৌঁছেছে। আগামীতে বাংলাদেশে শিল্পের অবদান আরও বাড়বে। তিনি আরও বলেন, বিশ্বের চারটি বিপ্লব সংগঠিত হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি বিপ্লবে বাংলাদেশ স্পর্শ করতে না পারলেও বর্তমানে প্রযুক্তি বিপ্লবে বাংলাদেশ বিশ্বের সঙ্গে সমানভাবে তাল মেলাচ্ছে।
আবুল কালাম আজাদ এমপি বলেন, শুধু শুধু পণ্যের বৈচিত্র্যময়তা আসবে না। শুধু ৮৫ ভাগ তৈরি পোশাক হবে। অন্য পণ্যের জন্য কি আমরা সে সুবিধা তৈরি করেছি। আরএমজি তে আমরা সেরাটি করেছি, বাকিগুলোর জন্য কিছুই করিনি। বাইরে থেকে তেমন ইনপুট দেইনি। বেসরকারি খাতসহ সংশ্লিষ্ট জনদের নিয়ে সমন্বিত উদ্যোগ নেবার সুযোগ সামনে। আমরা আমাদের সম্ভাবনা গুলোকে কাজে লাগাচ্ছি না।
থাইল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত বলেন, এখন আলোচনা হচ্ছে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে। এটিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। এদেশের দক্ষতা নিয়ে ভিন্ন দেশে গিয়ে শিল্পে যুত হওয়া বা নিজেরা শিল্প করলে, এটা নতুন একটি কৌশল হতে পারে।
পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেছেন, আমাদের ভৌগোলিক অবস্থান আমাদের বাণিজ্যে বড় একটা সুবিধাজনক অবস্থায় রেখেছে। বাংলাদেশের দারিদ্র্যতা দূরীকরণ জাতিসংঘে প্রশংসিত হয়েছে। রপ্তানি পণ্যের ৮৫ ভাগ তৈরি পোষাক, সীমিত কিছু বাজারে যাচ্ছে। অন্যান্য পণ্যগুলো চিহ্নিত। ন্যায্য মূল্য পাওয়া নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য পণ্যের মিক্সি হতে হবে। এখানে কূটনৈতিক তৎপরতা সবকিছু পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারে। কারণ তুলনামূলক স্বল্পমূল্যে শ্রমিক পাওয়া আমাদের একটি বড় সুবিধা। বাণিজ্যিক অংশীদারদের সাথে সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রান্সফরমেশনে আমাদের স্থানীয় ব্রান্ডের বিকাশ করার দিকে নজর দিতে হবে।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বিআইআইএসএসের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো: আবু বকর সিদ্দিক খান এনডিসি। সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান রাষ্ট্রদূত এ এফএম গওসোল আযম সরকার। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিআইআইএসএসের গবেষণা পরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম, ড. মো: দ্বীন ইসলাম, অধ্যাপক মুহাম্মদ শাহাদত হোসেন সিদ্দিকী এবং অধ্যাপক ডা. রোজানা রশিদ।
প্যানেল আলোচনা শেষে উন্মুক্ত সেশন আলোচনায় বক্তব্য রাখেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসেন মবিন চৌধুরী, রাষ্ট্রদূত আব্দুল হান্নানসহ আরও অনেকে। সেমিনারে জাপানের রাষ্ট্রদূত ইয়ামো কিমিনোরি, চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন, থাইল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত মাকাওয়াদি সুমিতমোর, বিমএসটেকের মহাসচিব ইন্দ্র মনি পান্ডে।
জাপানের রাষ্ট্রদূত তাঁর বক্তব্যে এলডিসি উত্তর বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ধরে রাখতে জাপানী বিনিয়োগ অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। সেইসঙ্গে পাট ওপাটজাত পণ্যসহ আরও নতুন নতুন পণ্যে আমদানিতে জাপানের আগ্রহের বিষয়টি তুলে ধরেন।
চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেন, চলতি বছরে চীন বাংলাদেশ থেকে আম আমদানি করেছে। আগামী বছরে আরও বেশি আম আমদানি করবে চীন। ভবিষ্যতে চীন বাংলাদেশ থেকে পাট ও পাটজাত পণ্যের আমদানির আগ্রহ দেখাচ্ছে। বাংলাদেশের সঙ্গে বহুমাত্রিক পণ্যের ব্যবসা প্রসারে চীন কাজ করছে।
সেমিনারে উন্মুক্ত আলোচনায় বক্তারা আগামীতে চ্যালেঞ্জের বাজারে বাংলাদেশ কিভাবে টিকতে পারে সেই বিষয়ে নানা পরামর্শ ও সুপারিশ তুলে ধরেন। আলোচনা সভায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, বাংলাদেশে কার্যরত বিদেশী রাষ্ট্রদূত এবং সাবেক কূটনীতিকরা নিজেদের মতামত তুলে ধরেন।
বক্তারা বলেন, এলডিসি গ্রাজুয়েশনে অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা, বর্ধিত সময়ে আমরা ঠিক কতটা সুবিধা পাবো, সেটার হিসেব নিকেশ এখন থেকেই করা দরকার। একইসাথে বেসরকারি খাতকে নিজেদেরকেই পণ্যের বহুমুখীকরণ করতে হবে। না হলে, সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ ও তথ্য প্রযুক্তির বহুমুখীকরণের কাজ একই সাথে ঘটতে হবে। কারণ একটাকে বাদ অন্যটার সুফল ঘরে তোলা যাবে না।
বক্তারা বলেন, আগামীর প্রতিযোগিতায় টিকতে পণ্যের বৈচিত্র্যময় করার সাথে সাথে বহুমাত্রিক বাজারে প্রবেশ করার কোন বিকল্প নেই। সেইজন্য নিরাপত্তা ও গুণগত মানের বিষয়টিই মাথায় রাখতে হবে। বিদেশে কৃষিজাত পণ্য তো বটেই, কৃষি শ্রমিক ও বিশেষজ্ঞ পাঠানোর সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পের মতো কৃষিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সক্ষমতা রাখে।
আলোচকরা বলেন, দেশি শিল্পগুলোকে বৈশ্বিক মানদন্ড মেনে ব্যবসা বান্ধব করতে বিদ্যমান নীতিমালা গুলোর সংস্কার করতে হবে। এছাড়া বিদেশের বাজারগুলোতে শুল্ক নিয়ে কাজ করার সুযোগ আছে। সেদিকে নজর দিতে হবে। আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তি বা আরটিএ এর ক্ষেত্রে পারষ্পরিক চুক্তিগুলো নিয়ে এগোনো সুবিধাজনক হবে। বিশেষ করে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোয় এটির বিষয়ে নজর দিতে হবে।
বক্তারা বলেন, অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা থেকে চ্যালেঞ্জ নিয়ে নিজেদের সক্ষমতাকে এগিয়ে নেয়াটা বাংলাদেশের জন্য কল্যাণকর হবে। এতে করে টেকসই একটা অবস্থানে আমরা যেতে পারবো। যেনতেন বিনিয়োগ নয়, গুনগত সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ নিয়ে আসতে হবে। তা না হলে, বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ নিয়ে এগিয়ে যাওয়া মোটেই সহজ হবে না। সেমিনারে বলা হয়েছে, বিশেষজ্ঞ বহুমুখীকরণ ও বাণিজ্য বাল্ক করতে এখন সবচেয়ে নীতিগত সহায়তা বেশি প্রয়োজন হবে। নতুন বাজারে কাজ খোঁজা উদ্যোগতাদের আর্থিক সহায়তার সাথে সাথে নীতিগত সহায়তা সহজ করে দিতে হবে। তা না হলে বাজারে তারা সুবিধা করতে পারবে না। বক্তারা বলেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারও একেবার ছোট না। বিদেশী বিনিয়োগ এখানে আনলে, বিনিয়োগ বাড়ানোও খুব কঠিন হবে না। কাজটা বেশ সহজ হবে।