মহামারি ও গুজবের ধাক্কা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশের আর্থিক খাতের প্রধান চালিকাশক্তি ব্যাংক। ২০২২ সালে বেসরকারি খাতের অধিকাংশ ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা বেড়েছে। আমদানি-রপ্তানির কমিশন আয়, ব্যাংক ঋণের সুদ ও মাশুল আদায় বাড়ায় প্রভাব পড়েছে মুনাফায়। এসব ব্যবসা থেকে ভালো আয় করেছে ব্যাংকগুলো। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের নিবিড় তদারকিতে প্রবাসীয় আয় বেড়েছে ব্যাংকিং চ্যানেলে। সাম্প্রতিক গুজবে মানুষের মধ্যে যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল, তা অনেকটাই কেটেছে। গ্রাহকরা আবার ব্যাংকে আমানত রাখা শুরু করেছেন। আসন্ন রমজানে নিত্যপণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে জনগণের পাশে আছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন চার বাণিজ্যিক ব্যাংক।
ইতিবাচক ধারায় প্রবাসী আয়
দেশে ডলারের সংকট কাটাতে বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক। বৈধপথে রেমিট্যান্স পাঠাতে প্রবাসীদের উৎসাহী করতে প্রণোদনা দেওয়ার পাশাপাশি সচেতন করা হচ্ছে। বৈধ পথে রেমিট্যান্স আনতে বিভিন্ন শর্ত শিথিল, চার্জ-ফি মওকুফসহ বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বৈধ উপায়ে ওয়েজ আর্নার্স রেমিট্যান্সের বিপরীতে আড়াই শতাংশ নগদ প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। রেমিট্যান্স প্রেরণকারীদের সিআইপি সম্মাননা দেওয়া হচ্ছে। রেমিট্যান্স বিতরণ প্রক্রিয়া সহজ ও সম্প্রসারণ করা হয়েছে। অনিবাসী বাংলাদেশিদের জন্য বিনিয়োগ ও গৃহায়ণ অর্থায়ন সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। রেমিট্যান্স প্রেরণে ব্যাংক বা এক্সচেঞ্জ হাউসগুলোর চার্জ ফি মওকুফ করা হয়েছে। এসব কারণে চলতি বছরই সুখবর এসেছে রেমিট্যান্সে। নতুন বছরে ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স। জানুয়ারির ২৭ দিনে ব্যাংকিং চ্যানেলে ১৬৭ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় (প্রতি ডলার ১০৭ টাকা হিসাবে) প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা। প্রতিদিন আসছে ৬ কোটি ডলারের বেশি রেমিট্যান্স। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরের ডিসেম্বরে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৬৯ কোটি ডলার। চলতি ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই ও আগস্ট) টানা ২০০ কোটি ডলার করে রেমিট্যান্স এসেছিল দেশে। পরের মাস সেপ্টেম্বর থেকে টানা পাঁচ মাস ১৫০ কোটি ডলারের ঘরে ছিল প্রবাসী আয়। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে এসেছিল ২০৯ কোটি ৬৩ লাখ ডলার, আগস্টে এসেছিল ২০৩ কোটি ৬৯ লাখ ডলার।
পরিচালন মুনাফা বেড়েছে অধিকাংশ ব্যাংকের
২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে অধিকাংশ ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা বেড়েছে। বছর শেষে ব্যাংকগুলোর মুনাফার হিসাবে দেখা যায়, অধিকাংশ ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে। ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে পাওয়া তথ্যমতে, ২০২২ সাল শেষে ১২টি ব্যাংকের মুনাফা বেড়েছে ১ হাজার ২৩২ কোটি টাকা। এসব ব্যাংকের মুনাফার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা। আগের বছর মুনাফার পরিমাণ ছিল ৮ হাজার ৫১২ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলো থেকে পাওয়া সর্বশেষ তথ্যে দেখা গেছে, ২০২২ সালে বেসরকারি খাতের ইসলামী ব্যাংকের মোট পরিচালন মুনাফা হয়েছে ২ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা। আগের বছর ২০২১ সালে ব্যাংকটির মুনাফা ছিল ২ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন রূপালী ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা হয়েছে ২১১ কোটি টাকা, যা আগের বছরে ছিল ১৪৭ কোটি টাকা। মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা হয়েছে ৮৪৫ কোটি টাকা, যা আগের বছরে ছিল ৭২২ কোটি টাকা। যমুনা ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা দাঁড়িয়েছে ৮৩০ কোটি টাকা। আগের বছর ছিল ৭০০ কোটি টাকা। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা হয়েছে ৫৫০ কোটি টাকা, যা আগের বছরে ছিল ৫০১ কোটি টাকা। এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের মুনাফা হয়েছে ৪৫৫ কোটি টাকা। আগের বছর ছিল ৪০৫ কোটি টাকা। সাউথইস্ট ব্যাংকের মুনাফার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা। ২০২১ সালে মুনাফা ছিল ১ হাজার ১৬ কোটি টাকা। সোনালী ব্যাংকের মুনাফার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৪২০ কোটি টাকা। আগের বছর মুনাফা ছিল ২ হাজার ২১ কোটি টাকা। ইউনিয়ন ব্যাংকের মুনাফা হয়েছে ৪৫০ কোটি টাকা। ২০২১ সালে মুনাফা ছিল ৩৬০ কোটি টাকা। ছয় মাসে সিটিজেন ব্যাংক মুনাফা করেছে ২ কোটি ৫৪ লাখ টাকা।
আমানত বেড়েছে ব্যাংক খাতে
চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বরে ব্যাংকিং খাতে আমানত বেড়েছে ১৮ হাজার ৯৮২ কোটি টাকা। ২০১৯ সালের অক্টোবরে আমানত ছিল ১১ লাখ ৬ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা। ২০২০ সালের অক্টোবরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ লাখ ৫১ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা। ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে আমানত বেড়েছিল ১ লাখ ৪৪ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা। আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩ শতাংশ। ২০২১ সালের অক্টোবরে আমানত বেড়ে দাঁড়ায় ১৩ লাখ ৮৮ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকা। ওই এক বছরে ব্যাংকে আমানত বেড়েছে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা। শতকরা হিসাবে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ৯৪ শতাংশ। ২০২২ সালের নভেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৯০ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা। ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে আমানত প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
রমজানের পণ্য সরবরাহে জনগণের পাশে রাষ্ট্রীয় চার ব্যাংক
আসন্ন রমজানে প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে জনগণের পাশে রয়েছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অগ্রণী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক ও রূপালী ব্যাংক।
এ বিষয়ে জনতা ব্যাংকের এমডি আবদুছ ছালাম আজাদ সাংবাদিকদের বলেন, প্রবাসী আয় ও পণ্য রপ্তানি বেড়েছে। ডলার পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। বেসরকারি ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রেও বিশেষ একটা ব্যবস্থা করা যায় কি না, সে বিষয়ে গভর্নর মহোদয়কে অনুরোধ করেছি আমরা। আশা করছি, নিত্যপণ্য আমদানিতে কোনো সমস্যা হবে না। সরকারি ব্যাংক হিসেবে আমরা জনগণের পাশে আছি। এর আগে রমজানে বাজারে নিত্যপণ্যের সংকট কাটাতে এসব পণ্য আমদানির ঋণপত্র খুলতে ব্যবসায়ীদের সহায়তা দিতে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চার বাণিজ্যিক ব্যাংককে নির্দেশনা দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার অর্থ সচিবের দায়িত্ব পালনকালেই ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে ৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ (বিবিএসের নতুন হিসাবে, পুরোনো হিসাবে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ) অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি (জিডিপি প্রবৃদ্ধি) অর্জিত হয়; যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি।
দুই বছরের বেশি সময়ের করোনা মহামারির সংকট মোকাবিলাতেও অর্থ সচিব হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি। চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কা সামলে অর্থনীতিকে সঠিক পথে আনতেও রউফ তালুকদার বিশেষ ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন।