নৌ প্রটোকল চুক্তির আওতায় রাজশাহীর পদ্মা তীরবর্তী গোদাগাড়ী উপজেলার সুলতানগঞ্জ নৌবন্দরটি আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হচ্ছে ১২ ফেব্রুয়ারি। এ বিষয়ে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় ও অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) সুলতানগঞ্জ নদী-বন্দর আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধনের বিষয়টি চূড়ান্ত করেছেন।
উদ্বোধনের পর রাজশাহীর সুলতানগঞ্জ ঘাটটি নদী বন্দরের মর্যাদা পাবে। উদ্বোধনের পর সুলতানগঞ্জ নদী বন্দরের মাধ্যমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদবাদ জেলার সাগরদিঘি থানার ময়া ঘাট বা নদী বন্দরের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য শুরু হবে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে নৌপরিবহণ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর একান্ত সচিব (পিএস) মোহা. আমিনুর রহমান বলেন, রাজশাহীর সুলতানগঞ্জ নদী বন্দর আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হবে ১২ ফেব্রুয়ারি। উদ্বোধনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে।
উদ্বোধনী অনষ্ঠানে নৌপরিবহণ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন, ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার মি. প্রণয় ভার্মা, অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কমোডর আফির আহমেদ মোস্তফাসহ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহীর পদ্মার তীরবর্তী সুলতানগঞ্জ নৌবন্দর চালু হলে এই পথে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার সাগরদিঘি থানার ময়া নৌবন্দরের সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য শুরু হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে এই পথে ভারত থেকে সিমেন্ট তৈরির কাঁচামাল, পাথর, মার্বেল, খনিজ বালু ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের খাদ্য সামগ্রী বাংলাদেশে আসবে।
অন্যদিকে এই পথে বাংলাদেশ থেকে বস্ত্র, মাছ, পাট ও পাটজাত পণ্য ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের কৃষিপণ্য ভারতে যাবে। এসব পণ্য মূলত বিভিন্ন স্থলবন্দরের মাধ্যমে সড়ক ও রেলপথে বাংলাদেশে আমদানি করা হয়।
সুলতানগঞ্জ নৌবন্দরের মাধ্যমে এসব পণ্য ভারত থেকে আমদানিতে সময় ও খরচ বহুলাংশে কমে যাবে। এতে উপকৃত হবেন বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশের ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীরা আশা করছেন, বছরে এই নৌপথে দুই দেশের মধ্যে হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, এর আগে নিয়ে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের সভায় সিদ্ধান্ত হয় বাংলাদেশের রাজশাহীর সুলতানগঞ্জ আর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ধুলিয়ান নৌরুটে বাণিজ্য চালুর। রাজশাহী থেকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের ধুলিয়ান পর্যন্ত ৭৮ কিলোমিটার একটি নৌপথের অনুমোদন থাকলেও পদ্মার নাব্যতা সংকটের কারণে কার্যকর করা হয়নি। ফলে রুটটি সংক্ষিপ্ত করে রাজশাহীর গোদাগাড়ীর সুলতানগঞ্জ থেকে ভারতের মুর্শিদাবাদের ময়া নৌবন্দর পর্যন্ত আড়াআড়িভাবে ২০ কিলোমিটার পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে পণ্য আনা নেওয়া হবে। শুরুতে এই নৌপথে ভারত থেকে পাথর বালি ও বিভিন্ন ধরণের খাদ্য সামগ্রী আনা হবে।
অন্যদিকে বাংলাদেশের আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা জানান, বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়ন কাজের জন্য প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ পাকুড় ব্র্যান্ডের পাথর ও খনিজ বালুর প্রয়োজন হয়। বর্তমানে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও যমুনা রেলসেতুর মতো বড় বড় প্রকল্পে ব্যবহার হচ্ছে ঝাড়খণ্ডের পাকুর ব্র্যান্ডের পাথর; যা সড়ক ও রেলপথের মাধ্যমে বাংলাদেশে আসছে। তবে সড়ক পথে এসব পণ্য আমদানিতে সময় যেমন বেশি লাগে তেমনি খরচ বেশি পড়ে। নৌপথে এসব পণ্য আমদানি করা গেলে পরিবহণ খরচ বহুলাংশে কম পড়বে।
উল্লেখ্য, পদ্মা-মহানন্দার মোহনায় অবস্থিত সুলতানগঞ্জ পদ্মায় সারা বছর নৌ চলাচল উপযোগী পানি থাকে। বিপরীতে ভারতের ময়া বন্দরটিতেও সারা বছর পানি থাকে। শুষ্ক মৌসুমে পদ্মার মধ্যখানে কিছু পথে নাব্যতা কমে যায়। তবে তেমন পরিস্থিতির উদ্ভব হবে দুই দেশের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে পদ্মায় ড্রেজিং করে নৌপথটি সারাবছর সচল রাখা হবে। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ময়া থেকে বাংলাদেশের রাজশাহীর সুলতানগঞ্জ আসতে পণ্যবাহী নৌযান মাত্র এক ঘণ্টায় আসতে পারবে।
অন্যদিকে প্রস্তাবিত সুলতানগঞ্জ নৌবন্দর চালু প্রসঙ্গে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমোডর আরিফ আহমেদ মোস্তফা বলেন, বাংলাদেশ-ভারত নৌপ্রটোকলের আওতায় নদীপথে দুই দেশের মধ্যে কম খরচে বিপুল পরিমাণ বাণিজ্য বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। রাজশাহীর সুলতানগঞ্জে নৌবন্দরের কার্যক্রম চালু হলে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার ময়া নৌবন্দরের সঙ্গে নদীপথে বাণিজ্য শুরু হবে। এর ফলে বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশের ব্যবসায়ীরাই উপকৃত হবেন। সুলতানগঞ্জ-ময়া একটি লাভজনক ও চমৎকার নৌরুট হতে পারে। দুই পাড়েই অবকাঠামোগত কিছু সমস্যা এখনো রয়েছে। তবে সুলতানগঞ্জ বন্দর চালু হওয়ার পর পর্যায়ক্রমে সেগুলো ঠিক হয়ে যাবে।
এদিকে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যের সুলতানগঞ্জ-ময়া নৌরুট চালুর বিষয়ে গত কয়েক বছর ধরে চেষ্টা করে আসছেন রাজশাহী সিটি মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। তিনি বলেন, সুলতানগঞ্জ-ময়া নৌপথটি খুবই সম্ভাবনাময় একটি বাণিজ্য পথ। এই পথে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য শুরু হলে বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশই বিপুলভাবে লাভবান হবেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত নৌপ্রটোকলের আওতায় ২০২০ সালের অক্টোবরে সুলতানগঞ্জ-ময়া নৌপথটি চালুর কথা ছিল; কিন্তু করোনা মহামারির কারণে নৌপথটি চালুর কাজ পিছিয়ে যায়।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, সুলতানগঞ্জ থেকে ময়া নৌঘাটের নদীপথে দূরত্ব মাত্র ১৭ কিলোমিটার। সুলতানগঞ্জ নৌঘাটটি রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়ক থেকে মাত্র এক কিলোমিটার ভেতরে পদ্মা মহানন্দার মোহনায় অবস্থিত। সারা বছর সুলতানগঞ্জ পয়েন্টে পদ্মায় গভীর পানি থাকে। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের ময়া নৌঘাটটি মুর্শিদাবাদ জেলার জঙ্গিপুর মহকুমা শহরের কাছে ভারতীয় ৩৪নং জাতীয় সড়কের সঙ্গে যুক্ত। ফলে সুলতানগঞ্জ-ময়া পথে নৌবাণিজ্য শুরু হলে পরিবহণ খরচ অনেকাংশে কমবে।
স্থানীয়রা আরও জানান, ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আগপর্যন্ত সুলতানগঞ্জ-ময়া ও গোদাগাড়ী ও ভারতের লালগোলা নৌঘাটের মধ্যে নৌপথে বিপুল বাণিজ্য চালু ছিল। বাংলাদেশ থেকে এই পথে ভারতে বিপুল পরিমাণ পাট রফতানি হতো। বর্তমানে রাজশাহীতে প্রচুর মাছ উৎপাদন হয়। এই মাছ এই নৌপথে ভারতে রফতানি করা সম্ভব হবে। ভারত থেকে কয়লা, সিমেন্ট তৈরির উপকরণ ফ্লাই অ্যাশ, ক্লিংকার আমদানিও সম্ভব এই নৌপথে। কারণ ভারতে ঝাড়খণ্ড রাজ্যের পাকুড় থেকে মুর্শিদাবাদের ময়া বন্দরের দূরত্ব মাত্র ৫৫ কিলোমিটার।
জানা গেছে, ভারতের ময়া নৌঘাট থেকে বর্ষাকালে প্রতিটি নৌযানে ৩০০ টন পর্যন্ত পণ্য পরিবহণ করা যাবে।