বান্দরবানের আলীকদম এলাকা থেকে চট্টগ্রাম শহরে পাচার হচ্ছে বিপন্ন প্রজাতির একটি উল্লুক— সম্প্রতি ইন্টারপোল থেকে এমন সংবাদ আসে পুলিশ সদর দপ্তরে। পুলিশ সুপার (এসপি) পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা দ্রুত বিষয়টি অবহিত করেন চট্টগ্রামের লোহাগাড়া থানার ওসিকে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে বসানো হয় গোপন চেকপোস্ট।
কিন্তু এর মধ্যে উল্লুকটি কয়েকটি পাচারকারী চক্রের মধ্যে হাতবদল হয়। ফলে ইন্টারপোল থেকে প্রাপ্ত তথ্যে কোনোভাবেই উদ্ধার করা যাচ্ছিল না বিপন্নপ্রায় প্রাণীটি। একপর্যায়ে উপজেলার চুনতি অভয়ারণ্যের ফরেস্ট রেঞ্জ কর্মকর্তার কার্যালয়ের সামনে একটি যাত্রীবাহী বাস থেকে উল্লুকটি উদ্ধার করা হয়।
গত ৮ অক্টোবর ওই অভিযানের বিষয়ে লোহাগাড়া থানার ওসি মোহাম্মদ আতিকুর রহমান বলেন, হেডকোয়ার্টারের (সদর দপ্তর) মাধ্যমে ইন্টারপোল থেকে পাওয়া তথ্যে উল্লুকটি উদ্ধারের পাশাপাশি গ্রেপ্তার করা হয় মো. মুবিন (৩০) ও মাজহারুল (৩৫) নামের দুই পাচারকারীকে। পরে তাদের ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে এক বছর কারাদণ্ড এবং ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ থেকে পাচার হচ্ছে বিপন্নপ্রায় উল্লুক, কখনও লজ্জাবতী বানর। সজারুর সঙ্গে ধরা পড়ছে বনমোরগ, মেছোবিড়ালও। কক্সবাজার ও বান্দরবানের গহীন বনাঞ্চল থেকে বিপন্নপ্রায় এসব প্রাণী পাচার করছে একটি আন্তর্জাতিক চক্র। রুট (পাচারের পথ) হিসেবে তারা ব্যবহার করছে চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলা
‘উল্লুকটি উদ্ধারের আগে তিন গ্রুপের মধ্যে হাতবদল হয়। তাই উদ্ধারের ক্ষেত্রে একটু বেগ পেতে হয়েছে। আমরা মামলাটি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করছি। এই চক্রের আদ্যোপান্ত বের না হওয়া পর্যন্ত আমরা তদন্ত চালিয়ে যাব।’
পুলিশ সূত্র জানায়, ওই ঘটনার কয়েকদিন পর অর্থাৎ ২৭ অক্টোবর লোহাগাড়া বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয় একটি বনমোরগ ও তিনটি মেছোবিড়াল। বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার গহীন বন থেকে বিপন্নপ্রায় প্রাণী চারটি ধরা হয়। এরপর একটি নম্বরবিহীন মোটরসাইকেলে করে লামা-আজিজনগর হয়ে লোহাগাড়া বাসস্ট্যান্ড এলাকায় পৌঁছান মো. এমরান ও মো. আলীম উদ্দিন নামের দুই ব্যক্তি। সেখান থেকে একটি বাসে করে চট্টগ্রাম শহরের রিয়াজউদ্দিন বাজারে নেওয়ার কথা ছিল। তার আগেই লোহাগাড়া থানা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন দুই পাচারকারী।
উল্লুকটি উদ্ধারের আগে তিন গ্রুপের মধ্যে হাতবদল হয়। তাই উদ্ধারের ক্ষেত্রে একটু বেগ পেতে হয়েছে। আমরা মামলাটি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করছি।
এছাড়া গত ১০ নভেম্বর চুনতি অভয়ারণ্যের ফরেস্ট রেঞ্জ কর্মকর্তার কার্যালয়ের সামনে একটি যাত্রীবাহী বাস তল্লাশি করে উদ্ধার করা হয় একটি সজারু ও দুটি লজ্জাবতী বানর। এরশাদ নামের এক যুবক এসব প্রাণী কক্সবাজার থেকে ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছিলেন। ইন্টারপোল থেকে পাওয়া গোয়েন্দা তথ্য বিশ্লেষণ করে অভিযান তিনটি পরিচালনা করে লোহাগাড়া থানা পুলিশ।
এবার প্রাণীগুলো রক্ষায় বিশেষ অভিযানে নেমেছে লোহাগাড়া থানা পুলিশ। অভিযানের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নিজেই। তাকে সহায়তা করছে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল পুলিশ অর্গানাইজেশন (ইন্টারপোল)। সংস্থাটির আগ্রহে এসব বন্যপ্রাণী উদ্ধারে তৎপর হয়েছে পুলিশ সদর দপ্তরও। শুধু তা-ই নয়, লোহাগাড়া থানার অভিযান পুলিশ সদর দপ্তর থেকে নিয়মিত তদারকিও করা হচ্ছে।
ইন্টারপোলের ওয়েবসাইট ঘেঁটে জানা যায়, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য সারা বিশ্বে ‘Thunder 2022’ শিরোনামে অক্টোবর মাসব্যাপী অভিযান পরিচালনা করে সংস্থাটি। ২০১৭ সাল থেকে তারা অভিযান পরিচালনা করে আসছে। ২০২২ সালে ষষ্ঠবারের মতো চালানো ওই অভিযানে সর্বোচ্চ ১২৫ দেশের শুল্ক, পুলিশ, আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট, বন্যপ্রাণী ও বনাঞ্চল সংরক্ষণে জড়িত সংস্থা অংশ নেয়। তাদের অভিযান পরিচালনার জন্য নির্দেশনাও দেয় ইন্টারপোল। এ সময় গোয়েন্দা তথ্যে বিভিন্ন দেশ থেকে কাঠ থেকে শুরু করে জীবন্ত প্রাণী, পশুর অংশ ও পোশাক, সৌন্দর্য পণ্য, খাদ্যসামগ্রী, ঐতিহ্যবাহী ওষুধ ও হস্তশিল্প জব্দ করা হয়।
ইন্টারপোলের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, ষষ্ঠবারের অভিযানে অবৈধ ব্যবসা, প্রক্রিয়াকরণ, রপ্তানি, সুরক্ষিত বন্যপ্রাণী ও বনজপণ্য আমদানির সঙ্গে জড়িত ১৪১ প্রতিষ্ঠান ও ৯৩৪ জনকে শনাক্ত করা হয়। আটক করা হয় বিপন্নপ্রায় বিভিন্ন প্রজাতির ১১৯টি বিড়াল, ৩৪টি স্তন্যপায়ী প্রাণী, ২৫টি গন্ডারের শিং, ৩৪টি প্রাইমেট, ১৩৬টি প্রাইমেট শরীরের অঙ্গ, নয়টি প্যাঙ্গোলিন, ৩৮৯ কেজি প্যাঙ্গোলিনের খুলি, ৭৫০টি পাখি, ৪৫০টিরও বেশি পাখির অংশ, প্রায় ৭৮০ কেজি ও ৫১৬ টুকরো হাতির দাঁত, ২৭টি হাতির শরীরের অঙ্গ, ১৭৯৫টি সরীসৃপ এবং প্রায় ৫০০ কেজি সরীসৃপের অংশ এবং ১১৯০টি কচ্ছপসহ বিভিন্ন প্রাণীর অংশবিশেষ। এছাড়া উদ্ধার করা হয় বিপুল পরিমাণ কাঠ।
বিপন্নপ্রায় বন্যপ্রাণী উদ্ধারে ইন্টারপোলের সহযোগিতা নিয়ে কাজ করছে পুলিশ। বেশকিছু সফল অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। অভিযান আরও জোরদার করা হবে
শরীফ মোস্তাফিজুর রহমান, সহকারী মহাপরিদর্শক (ইন্টারপোল), পুলিশ সদর দপ্তর
অভিযানের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের বনাঞ্চলেও নজরদারি চালাচ্ছে ইন্টারপোল। তাদের গোয়েন্দা তথ্যে ভর করে বেশকিছু সফল অভিযান পরিচালনা করেছে পুলিশ। একই সঙ্গে উদ্ধার করেছে বিপন্নপ্রায় বিভিন্ন প্রাণী। তবে, অভিযান চলমান থাকায় কী পরিমাণ প্রাণী এবং প্রাণীর শরীরের অংশ উদ্ধার হয়েছে তার হিসাব করেনি পুলিশ সদর দপ্তর।
জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (ইন্টারপোল) শরীফ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘বিপন্নপ্রায় বন্যপ্রাণী উদ্ধারে ইন্টারপোলের সহযোগিতা নিয়ে কাজ করছে পুলিশ। বেশকিছু সফল অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। অভিযান আরও জোরদার করা হবে।’
বিশ্বব্যাপী বিশেষ অভিযানের বিষয়ে নিজেদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ইন্টারপোলের সেক্রেটারি জেনারেল জার্গেন স্টক বলেন, বৈশ্বিক নিরাপত্তার জন্য থান্ডার অপারেশনগুলো গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, কাঠ ও বন্যপ্রাণী শুধু সংরক্ষণের বিষয় নয়। এগুলো প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি মানুষের জীবনচক্রের সঙ্গেও জড়িত। অনৈতিকভাবে বড় আর্থিক লাভের আশায় গুরুতর এই সংঘবদ্ধ অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে।
কোথায় কোন কোন প্রাণী পাচার হচ্ছে
সংশ্লিষ্টদের মতে, বাংলাদেশ থেকে বাঘের চামড়া, হাতির দাঁত ও শরীরের বিভিন্ন অংশ, উল্লুক, কচ্ছপ, লজ্জাবতী বানর, বনরুই, মেছোবিড়াল, কড়ি কাইট্টা, গন্ধগোকুল, তক্ষক, ব্যাঙ, সাপ ও সাপের বিষসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণী এবং এসব প্রাণীর দেহের অংশ পাচার হয়ে থাকে। তবে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চক্র বাংলাদেশকে রুট হিসেবে ব্যবহার করছে। এক্ষেত্রে ভারত থেকে চীন, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া ও আফ্রিকার কয়েকটি দেশে এসব প্রাণী পাচার হচ্ছে।
আবার মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড থেকেও বাংলাদেশের রুট ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশে বন্যপ্রাণী পাচার হচ্ছে। পাচার হওয়া দেশগুলোতে ওইসব বন্যপ্রাণী ও তাদের দেহ বিশেষ ওষুধ ও খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে। অনেকে আবার খাঁচায় বন্দি করে বাসার সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য এসব প্রাণী ও তাদের দেহের অংশ কিনে থাকে। যদিও এতে ধ্বংস হচ্ছে বনাঞ্চল, ভেঙে পড়ছে বন্যপ্রাণীদের খাদ্যশৃঙ্খল। অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশ।
কী করছে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট
বাংলাদেশে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করছে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট। সংস্থাটি গত জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে ৩০৮টি অভিযান পরিচালনা করেছে। এসব অভিযানে ১১টি মেছোবিড়াল, ১২৬টি কড়ি কাইট্টা, ১৪টি শিয়াল, ৫৭টি সুন্ধি কাছিম, দুই হাজার ২৯১টি বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, ৯০টি সাপ, ২৮টি বানর, ১১টি গুইসাপ, ১৫টি বনবিড়াল, নোনা পানির কুমির একটি, বেজি চারটি, একটি বাঘাইড় মাছ, হনুমান ছয়টি, কাঠবিড়ালি তিনটি, গন্ধগোকুল ১২টি, তক্ষক ১৪টি, মায়া হরিণ দুটি, সবুজ ব্যাঙ ১৫০টি এবং একটি শুকর আটক করা হয়েছে। পরে সেগুলো প্রাকৃতিক পরিবেশে অবমুক্ত করা হয়েছে।
এছাড়া এ সময়ে পাচারকারীদের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় ছয়টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা রথীন্দ্র কুমার বিশ্বাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, শুধুমাত্র বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট ২০১২ থেকে ২০২২ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ৪২ হাজারের বেশি বন্যপ্রাণী আটক করে প্রাকৃতিক পরিবেশে অবমুক্ত করেছে। বন অধিদপ্তর, পুলিশ, র্যাব, কাস্টম, প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সারা বাংলাদেশের পাঁচশোর অধিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সহায়তায় এসব অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ইন্টারপোলসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা আমাদের সহায়তা করে থাকে।
শুধুমাত্র বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট ২০১২ থেকে ২০২২ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ৪২ হাজারের বেশি বন্যপ্রাণী আটক করে প্রাকৃতিক পরিবেশে অবমুক্ত করেছে। বন অধিদপ্তর, পুলিশ, র্যাব, কাস্টম, প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সারা বাংলাদেশের পাঁচশোর অধিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সহায়তায় এসব অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ইন্টারপোলসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা আমাদের সহায়তা করে থাকে
জানতে চাইলে বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের বন্যপ্রাণী শাখার বিভাগীয় কর্মকর্তা শেখ মোহাম্মদ রবিউল আলম বলেন, ‘পাচার এবং নির্বিচারে হত্যার কারণে বন্যপ্রাণী ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। কিছু কিছু প্রজাতি বিলুপ্তও হয়ে যাচ্ছে। আর্থিক লোভে পাচারকারীরা বন্যপ্রাণী এবং তাদের দেহের বিভিন্ন অংশ বিদেশে পাঠিয়ে থাকে। এতে পরিবেশ ভারসাম্য হারাচ্ছে। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে নিয়মিত সমন্বয় সভা হতে হবে। নজরদারি ও অভিযান বাড়াতে বিশেষায়িত সংস্থা বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের জনবল বাড়ানো উচিত।'