উমেশ পাল হত্যাকাণ্ডের পর ৫১ দিন। আশঙ্কা সত্যি প্রমাণ করে শেষমেশ মৃত্যুতে এসে থামল ‘গ্যাংস্টার’ আতিক আহমেদের জীবন। গুজরাতের সাবরমতী জেল থেকে উত্তরপ্রদেশের জেলে আনার বিষয়টি নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে আদালতে আর্জি জানিয়েছিলেন আতিক। তাঁকে ‘এনকাউন্টার’ করা হতে পারে, এমন আশঙ্কার কথাও বলেছিলেন প্রাক্তন সাংসদ এবং বিধায়ক আতিক।
শুধু আদালতেই নয়, জেলের বাইরেও সাংবাদিকদের আতিক বলেছিলেন, “হত্যা, হত্যা, হত্যা। ওদের (সরকার) পুরো পরিকল্পনা আমার জানা আছে। আমাকে খুন করতে চায় ওরা।” গত ১৩ এপ্রিল প্রয়াগরাজে জেরার জন্য আতিককে নিয়ে আসা হয়েছিল। তখন সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আতিক বলেছিলেন, “আমি সরকারকে অনুরোধ করছি যে, আমি মাটিতে মিশে গিয়েছি। তাই আমার বাড়ির মহিলাদের, বাচ্চাদের ওরা যেন কেউ হয়রান না করে।”
ঘটনাচক্রে ১৩ এপ্রিলই পুলিশের ‘এনকাউন্টারে’ মৃত্যু হয় আতিকের তৃতীয় পুত্র আসাদের। তাঁর এক সঙ্গী গুলামেরও মৃত্যু হয় একই ঘটনায়। জেলে বসেই ছেলের মৃত্যুর খবর পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন আতিক। আসাদের শেষকৃত্যে যাওয়ার আর্জি জানিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তা মঞ্জুর করা হয়নি। এর পরই আসাদের মৃত্যুর জন্য নিজেকে দায়ী করেন আতিক।
শনিবার শারীরিক পরীক্ষা করতে আতিক এবং তাঁর ভাই আশরফকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল প্রয়াগরাজ মেডিক্যাল কলেজে। তখনই তাঁদের দু’জনকে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে মাথায় গুলি করে খুন করা হয়। এই ঘটনায় সানি, অরুণ এবং লবলেশ নামে তিন অভিযুক্তকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
২০০৫ সালে তৎকালীন ইলাহাবাদ পশ্চিমের বহুজন সমাজ পার্টির বিধায়ক রাজু পাল খুনের ঘটনায় অভিযোগ ওঠে আতিক এবং আশরফের বিরুদ্ধে। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে তার পর থেকেই লাগাতার সমস্যা বাড়ছিল আতিকের। সেই বৃত্তটা সম্পূর্ণ হয় রাজু খুনের একমাত্র সাক্ষী উমেশ পালের খুনের পর। উমেশ খুনেরও অভিযোগ ওঠে আতিক এবং আশরফের বিরুদ্ধে। ফলে আরও চাপে পড়েন আতিক এবং তাঁর গ্যাং।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রয়াগরাজে নিজের বাড়ির সামনে খুন হয়েছিলেন উমেশ পাল। সেই ঘটনায় তাঁর দুই দেহরক্ষীরও মৃত্যু হয়েছিল। উমেশ হত্যাকাণ্ডের কাহিনি শুরু হয়েছিল সিটিটিভি ফুটেজ দিয়েই।এবং শেষ হল আতিকের মৃত্যুর লাইভ ভিডিয়োয়।
উমেশ হাত্যাকাণ্ডের সিসিটিভি ফুটেজ থেকে পুলিশ জানতে পারে, এই খুনের অন্যতম মাথা ছিলেন আতিকের পুত্র আসাদ এবং আতিক-গ্যাং। ক্রমে সেই হত্যাকাণ্ডের রহস্য পরতে পরতে খুলতে খুলতে আতিক এবং আশরফের নাম জড়িয়ে গিয়েছিল। উমেশ হত্যার পর ৫১ দিনে পুরো পাশা পাল্টে যায়। শেষমেশ খুন হতে হল আতিক এবং আশরফকে।
শনিবার সংবাদমাধ্যমে কথা বলার সময় আতিককে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি করেন তিন যুবক। এই ঘটনার যে ভিডিয়ো প্রকাশ্যে এসেছে, তাতে দেখা গিয়েছে, পুলিশ ওই আততায়ীদের মাটিতে ঠেসে ধরে রেখেছে, আর তাঁরা ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দিচ্ছেন। যদিও ভিডিয়োটির সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার অনলাইন। লাইভ ভিডিয়োয় ধরা পড়েছে ভয়ঙ্কর সেই খুনের দৃশ্য।
২৪ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় আদালতে একটি মামলার শুনানিতে গিয়েছিলেন উমেশ পাল। সেখান থেকে গাড়ি চেপে বাড়ির সামনে পৌঁছতেই তাঁকে গুলি করে খুন করার অভিযোগ ওঠে আতিক গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে। বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি, তার পর বোমাবাজি করে পালায় দুষ্কৃতীরা।
উমেশ পাল হত্যার পর ২৫ ফেব্রুয়ারি এফআইআর দায়ের করেন তাঁর স্ত্রী। উমেশ হত্যার ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই ২৭ ফেব্রুয়ারি পুলিশের ‘এনকাউন্টারে’ এই ঘটনার অন্যতম অভিযুক্ত আরবাজের মৃত্যু হয়। ওই দিনই এই হত্যাকাণ্ডের অন্যতম ষড়যন্ত্রী সাদাকতকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
১ মার্চ জাফর আহমেদ নামে আতিকের এক ঘনিষ্ঠের বাড়ি বুলডোজ়ার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয় প্রয়াগরাজ জেলা প্রশাসন। ২ মার্চ রাজরূপপুরে এই হত্যাকাণ্ডের অন্যতম অভিযুক্ত অস্ত্রবিক্রেতা জারফর আহমেদের বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। ৩ মার্চ কৌশম্বীতে আতিকের আরও এক ঘনিষ্ঠের বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।
৫ মার্চ আতিকের তৃতীয় সন্তান আসাদ-সহ পাঁচ শুটারের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে আড়াই লক্ষ টাকা কের পুরস্কার ঘোষণা করে পুলিশ। উমেশ পালকে প্রথম গুলি মারার ঘটনায় অভিযুক্ত শুটার বিজয় চৌধরির পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয় ৬ মার্চ।
১১ মার্চ আতিকের স্ত্রী শায়িস্তার বিরুদ্ধে ২৫ টাকা ঘোষণা করে পুলিশ। ১৩ মার্চ আতিকের পুত্র আসাদ-সহ পাঁচ শুটারের বিরুদ্ধে পুরস্কারের অর্থ বাড়িয়ে ৫ লক্ষ টাকা করা হয়।
২০ মার্চ প্রয়াগরাজ প্রশাসন উমেশ হত্যাকাণ্ডের আর এক অভিযুক্ত তথা আসাদ-ঘনিষ্ঠ গুলামের বাড়ি ভেঙে দেয়। তার পর দিনই, অর্থাৎ ২১ মার্চ আতিকের কার্যালয় থেকে ৭২ লক্ষ টাকা বাজেয়াপ্ত করে পুলিশ। ওই দিনই আতিক-গ্যাংয়ের সদস্য নিয়াজ, মহম্মদ সজর, আরশাদ কটরা, কৈশ এবং রাকেশকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
২৭ মার্চ, গুজরাতের সাবরমতী জেল থেকে উমেশ পাল অপহরণের মামলায় প্রয়াগরাজে নিয়ে আসা হয় আতিক এবং আশরফকে। সেই মামলায় ২৮ মার্চ আতিক, খান সৌলত হানিফ এবং দীনেশ পাসীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় আদালত। আরশফ-সহ কয়েক জনকে বেকসুর খালাস করা হয়।
১ এপ্রিল ধুমনগঞ্জ পুলিশ মেরঠ থেকে আতিকের বোনের স্বামী ডঃ আখলাককে গ্রেফতার করে। ২ এপ্রিল আতিকের পরিচারক শাহরুখকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
জেলে বন্দি থাকা অবস্থাতেও ৩ এপ্রিল আতিক এবং আশরফের বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি করা হয়। ৫ এপ্রিল রাজু পাল হত্যাকাণ্ডের অন্যতম অভিযুক্ত আব্দুল কবি আত্মসমর্পণ করেন।
৭ এপ্রিল আতিকের স্ত্রী শায়িস্তার বিরুদ্ধে পুরস্কারে অর্থ বাড়িয়ে দেয় পুলিশ। ২৫ হাজার থেকে তা বাড়িয়ে ৫০ হাজার করা হয়। ৮ এপ্রিল পুলিশ আতিকের বোন এবং তাঁর মেয়েদের ‘ওয়ান্টেড’ তালিকায় নথিভুক্ত করে।
৯ এপ্রিল দিল্লি পুলিশের স্পেশাল সেল আতিকের তিন সহযোগীকে গ্রেফতার করে। ১৩ এপ্রিল ঝাঁসিতে পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয় আতিকের পুত্র আসাদ এবং তাঁর সঙ্গী গুলামের।
১৫ এপ্রিল প্রয়াগরাজ মেডিক্যাল কলেজে আততায়ীদের গুলিতে মৃত্যু হয় আতিক এবং তাঁর ভাই আশরফের।
সূত্র - আনন্দবাজার