রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা সালমা আক্তার তাঁর দুই সন্তানকে নিয়ে ঈদের ছুটি কাটিয়ে গতকাল শুক্রবার নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থেকে ঢাকায় ফিরেছেন। সন্তানদের স্কুল খোলা রোববার। কিন্তু ঢাকায় আসার পর বৈশাখের প্রচণ্ড খরতাপে তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে বলছিলেন, আগামী কয়েক দিন তাঁর সন্তানকে স্কুলে পাঠাবেন না। পড়াশোনার ক্ষতি যদি হয়, হোক।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বয়ে যাচ্ছে তাপপ্রবাহ। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে গরমের তীব্রতা। তীব্র গরমে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। দেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া তাপপ্রবাহে গরম আরও বেড়ে যাওয়ার শঙ্কায় গতকাল তিন দিনের জন্য হিট অ্যালার্ট দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এমন পরিস্থিতিতে সালমা আক্তারের মতো অন্য অভিভাবকরাও সন্তানদের নিয়ে চিন্তান্বিত।
গত বছরের মতো এবারও গরমে স্কুল বন্ধ থাকবে কিনা– স্পষ্ট নয়। তবে ঝড়-বন্যার মতো হিট অ্যালার্টকেও দুর্যোগ হিসেবে চিহ্নিত করে তা মোকাবিলায় স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশল অবলম্বনের ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, দেশের কয়েকটি জেলার ওপর দিয়ে তীব্র এবং বেশির ভাগ অঞ্চলে মাঝারি ও মৃদু তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। প্রচণ্ড গরম এপ্রিল মাসজুড়েই থাকবে। এ অবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি ৭ দিন বাড়ানোর দাবি জানিয়েছে অভিভাবক ঐক্য ফোরাম। গতকাল সংগঠনের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউল কবির দুলু স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ দাবি জানানো হয়।
টানা চার দিন ধরে চুয়াডাঙ্গা জেলায় দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বিরাজ করছে। গতকাল দুপুর পর্যন্ত জেলায় সর্বোচ্চ ৪১ দশমিক ৫ ডিগ্রি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে, যা এ মৌসুমের সর্বোচ্চ বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদ হাফিজুর রহমান। এ সময় ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৮ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
চট্টগ্রামের আনোয়ারায় গতকাল হিট স্ট্রোকে শাহজাদা ছালেহ আহমেদ (৭০) নামে একজনের মৃত্যু হয়েছে। তিনি উপজেলার রায়পুর ইউনিয়নের উত্তর পরুয়াপাড়া এলাকার বাসিন্দা ছিলেন।
অসহনীয় গরমে বাইরে কাজ করা শ্রমজীবী মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। স্বাভাবিক সময়ের সমপরিমাণ কাজ করতে না পারায় তাদের আয় কমেছে। শিশু ও প্রবীণরা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। মানুষের ভোগান্তি বহুগুণ বাড়িয়েছে বারবার লোডশেডিং।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজধানীর একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বলেন, কয়েক দিনের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা দরকার। কারণ, শ্রেণিকক্ষে বিদ্যুৎ না থাকলে গরমে শিশুদের অসুস্থ হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
তাপপ্রবাহের মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা বিষয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকের মাধ্যমে সমন্বিত সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এম তারিক আহসান।
আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক সতর্কবার্তায় জানিয়েছেন, দেশের বিভিন্ন এলাকায় চলমান মৃদু থেকে তীব্র তাপপ্রবাহ আরও তিন দিন থাকতে পারে। বাতাসে জলীয় বাষ্পের আধিক্যের কারণে বাড়তে পারে অস্বস্তি।
তবে তিন দিন পরও তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদ হাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, এর পরও তাপপ্রবাহ থাকার আশঙ্কা রয়েছে। তিন দিন করে সতর্কবার্তা দেওয়া হয়।
তীব্র গরমে স্বাস্থ্যঝুঁকি ও হিট স্ট্রোক এড়াতে চুয়াডাঙ্গায় মাইকিং করে জনগণকে সচেতন করছে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন। খুব প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে বের হতে নিষেধ করা হচ্ছে। শিশু ও বয়স্কদের ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে অনুরোধ করা হচ্ছে।
এ পরিস্থিতিতে অভিভাবকদের পক্ষ থেকে চলমান তাপদাহ স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার দাবি উঠেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গ্রীষ্মকালীন ছুটি এগিয়ে আনার দাবি করেছেন কেউ কেউ।
তাপদাহের ব্যাপারটি ইতোমধ্যে শিক্ষা অধিদপ্তরকে জানিয়েছেন চুয়াডাঙ্গার জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আতাউর রহমান। তবে এখনও কোনো নির্দেশনা আসেনি বলে জানান তিনি।
চলতি মৌসুমে রাজশাহীতে সর্বোচ্চ ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে গতকাল। আগের দিন বৃহস্পতিবার ৩৯ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং বুধবার ৪০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় এ জেলায়।
গত বছর পাবনার ঈশ্বরদীতে ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছিল। ১৯৯৫ এবং ২০০২ সালেও সমান তাপমাত্রা উঠেছিল। ২০১৪ সালে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল চুয়াডাঙ্গায়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১৮ মে রাজশাহীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছিল ৪৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, যা দেশে আবহাওয়ার রেকর্ড রাখা শুরুর পর সর্বোচ্চ।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ তরিফুল নেওয়াজ কবীর বলেন, এই গরমে মানুষের অস্বস্তি বেশি হওয়ার কারণ, এখন বাতাসে প্রচুর জলীয় বাষ্প আছে। এর ফলে প্রচুর ঘাম হয়। তাতে মানুষ ক্লান্ত হয় এবং শরীর দুর্বল হয়ে যায়। আগামী তিন দিন তাপমাত্রা কমার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এ সময় তাপমাত্রা কমা-বাড়ার মধ্যেই থাকতে পারে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব হেলথ সায়েন্সেসের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী বলেন, শরীর থেকে পানি ও লবণ কমে গেলে মানুষ শকে চলে যেতে পারে। ব্লাডপ্রেশার কমে যেতে পারে; মস্তিষ্কে রক্তের প্রবাহ বন্ধ হয়ে অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে; কিডনি অচল ও ইলেক্ট্রোলাইট ইমব্যালান্স হয়ে যেতে পারে। তীব্র গরমে শিশু, বয়স্ক ও অসুস্থ ব্যক্তিরা বেশি ঝুঁকিতে থাকে।
তিনি বলেন, ঝড় ও বন্যার মতো হিট অ্যালার্টকে আমরা এখনও তেমনভাবে দুর্যোগ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারিনি। হিট অ্যালার্ট যে স্বাস্থ্যের জন্য বড় দুর্যোগ– তা আমাদের উপলব্ধি করার সময় এসেছে। শুধু হিট অ্যালার্ট ঘোষণা করেই দায়িত্ব শেষ করলে হবে না। তীব্র গরমকে দুর্যোগ হিসেবে চিহ্নিত করে শ্রমজীবী মানুষের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।
গরমে সুস্থ থাকতে করণীয় সম্পর্কে এ চিকিৎসাবিজ্ঞানী বলেন, এ সময় অনেক পানি পান করতে হবে; সঙ্গে ফলের জুস রাখা যেতে পারে। সহজে হজমযোগ্য তরল খাবার খেতে হবে। প্রচুর ঘাম হলে স্যালাইন বা হালকা লবণ মিশ্রিত পানি পান করতে হবে। খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া
বাইরে যাওয়া যাবে না।